গায়েহলুদ থেকে শুরু করে নানা আনুষ্ঠানিকতা— উৎসবমুখর ছিল প্রতিটি মুহূর্ত। বাবা-হারা কন্যার বিয়েতে এত আয়োজন দেখে আনন্দিত এলাকাবাসী। সাথীর বিয়েতে ঢল নেমেছিল আত্মীয়স্বজন ও উৎসুক জনতার। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও নবদম্পতিকে স্বাবলম্বী করতে সার্বিক সহায়তা করছে ফজিলা কালাম ফাউন্ডেশন।

এই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় নতুন বছর শুরুর আগের দিন হয়ে যায় জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। পাত্র খোঁজা থেকে শুরু করে বিয়ে— সব ব্যয়ভার বহন করে সংস্থাটি।

সাথী রানীর বিয়েতে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল আলীম মাহমুদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবু তুষার কান্তি মন্ডল, ফজিলা কালাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ফজলুল হক মিলন, কো-চেয়ারম্যান সোলায়মান মিয়াসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

বলছিলাম রংপুর নগরীর ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম বগছি গ্রামের কৃষ্ণা রানী ও মেয়ে সাথী রানীর কথা। কিন্তু তাদের জীবনে ছিল দীর্ঘ সংগ্রাম।

২০০৩ সালে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন সাথী রানী। সাথী রানী আর দশটা শিশুর মতো স্বপ্নময় এক কন্যা। তবে জন্মের পরই হোঁচট খান। স্নেহ আর ভালোবাসাবঞ্চিত রেখে তিন বছর বয়সেই দূর আকাশে পাড়ি দেন বাবা ননী গোপাল বর্মন। তারপর বাবার ভূমিকায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন মা কৃষ্ণা রানী। তিল তিল করে বেড়ে ওঠা সাথীকে আগলে রেখেছেন। কখনো বুঝতে দেননি বাবার শূন্যতা।

মা হিসেবে নিজের আদর, স্নেহ, মমতার চাদরে সাথীকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ করেছেন। সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিতে যোগ দেন ঝিয়ের কাজে। মেয়ে সাথীকে পড়িয়েছেন স্কুলে। কিন্তু অর্থিক সংকটই বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় অসহায় কৃষ্ণার।

অনেক স্বপ্ন ছিল সাথীকে উচ্চশিক্ষিত করবেন। মেয়েও বড় হয়ে চাকরি করবে। কিন্তু এই স্বপ্ন দিন দিন কষ্টময় হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হন মা। এবার সেখানেও বাধা। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি না পেরোনো সাথীর বিয়ে ভাঙতে বসে আর্থিক সংকটে। বারবার হোঁচটে দিশেহারা হয়ে পড়েন নিরুপায় মা। এই দুঃসময়ে হাত বাড়ায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ফজিলা কালাম ফাউন্ডেশন’।

এবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও মায়ের স্বপ্নপূরণে দৃঢ় অবিচল সাথী রানী। জীবনসঙ্গীকে নিয়েই উচ্চশিক্ষা শেষ করে হতে চান বিসিএস ক্যাডার। সাথী রানীর এই স্বপ্নপূরণে পাশে থেকে সাহস জোগাতে প্রস্তুত তার উচ্চ শিক্ষিত স্বামী দীপাঙ্ক। মা কৃষ্ণা রানীও ভীষণ খুশি স্বপ্ন ছুঁতে যাওয়া মেয়ে সাথীকে নিয়ে।

২০১৯ সালে ওই গ্রামের আজিজুল্লাহ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সাথী রানী। এরপর মাহিগঞ্জ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক সংকটে মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হন কৃষ্ণা রানী।

মেয়ের বিয়ে প্রসঙ্গে মা কৃষ্ণা রানী বলেন, আমার স্বামীও অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। কিন্তু সাথীর জন্মের তিন বছরের মাথায় তিনি মারা যান। তখন অভাবের সংসারে এক বেলা খাবার জোটানো কষ্টকর ছিল। তারপরও অনেক কষ্ট করে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছি। স্বপ্ন ছিল মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করব। কিন্তু অভাবের কারণে অনেক কিছুই সম্ভব হয়নি।

তিনি আরও বলেন, সাথীর খুব ইচ্ছে সে পড়াশেঅনা করবে। আমি চেষ্টা করেছি যতদূর পর্যন্ত পড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন কারণে মেয়েকে বিয়ে দিতে মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু অর্থাভাবে সেই স্বপ্নটাও ভাঙতে বসেছিল। পরে একটা সংস্থার লোকজন আমাকে সহযোগিতা করেছে। তারাই ধুমধাম করে আমার মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেছে।

সাথী রানী বলেন, আমার খুব ইচ্ছা আছে জীবনে বড় হব, বিসিএস ক্যাডার হব। আমার স্বামীও আমার স্বপ্নপূরণে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন সবার কাছ থেকে দোয়া চাই।

সাথীর স্বামী দীপঙ্ক বলেন, সাথীর ইচ্ছে পড়ালেখা করা। এটা খুব ভালো লাগছে। আমি ওকে সহযোগিতা করব। ওর যেন ইচ্ছে পূরণ হয়।

বিয়ের আয়োজন প্রসঙ্গে ফজিলা কালাম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ফজলুল হক বলেন, সাথীর বিয়ে ও তাকে স্বাবলম্বী করার দায়িত্ব আমরা নিতে পেরেছি. এটা ভেবে ভালো লাগছে। আমরা ১০ বছর ধরে এতিম কন্যাদের বিয়ের যাবতীয় খরচ বহন করার পাশাপাশি দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচও বহন করে আসছি।

রংপুর সিটি করপোরেশনের মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, এমন পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়। এমন আয়োজন দেখে ভালো লেগেছে। আমাদের সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় মানুষের জন্য এমন উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর হবে। সাথীর স্বপ্নপূরণে আমি নিজেও যতটুকু পারি সহযোগিতা করব।

এনএ