নদীর মাঝ দিয়ে কয়লা-পাথরবোঝাই গাড়ি চলাচলের জন্য বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা। প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধ দিয়ে রাস্তা করার ফলে নদীর নাব্যতা হারিয়ে চর তৈরি হয়েছে। এতে নদীর একপাশে শুষ্ক মৌসুমে হয়ে যায় প্রাণহীন মরুভূমি। এছাড়া পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাওরপাড়ের মানুষ।

তাহিরপুরের পাটলাই নদীতে কৃত্রিমভাবে নদীর বুকে সড়ক করার ফলে এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। প্রশাসন বলছে, নদীর মাঝে বাঁধ দিয়ে সড়ক নির্মাণের বিষয়ে জানেন না তারা। সরজমিনে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তাহিরপুরের সীমান্তঘেঁষা নদী পাটলাই। এই নদী ঘিরেই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়েছে। এই এলাকার সঙ্গে ভৈরবসহ দেশে নদীপথের সংযোগপথ তৈরি হয়েছে। এই নদী দিয়েই ব্যবসায়ীরা কয়লা, পাথর দেশের বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি করেন। এছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ঢাকা, ভৈরব থেকে মালামাল পরিবহন করে পাটলাই নদী দিয়ে।

তবে বছরের পর বছর তাহিরপুরের উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের ডাম্পের বাজার ও নতুনবাজার অংশে বাঁধ দিয়ে রাস্তা করা হয়। উপজেলার ৩টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা পাথর পরিবহনের জন্য এমনটি করা হচ্ছে প্রতি বছর। এতে নদীর নাব্যতা হারিয়ে অনেক জায়গায় চর জেগেছে। ঘটছে অকাল বন্যা ও ফসলহানির মতো ঘটনা।

স্থানীয়রা বলছেন, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে বাঁধ অপসারণ করে নদী খনন করতে হবে। এতে সারাদেশে বাণিজ্যিক এলাকা তাহিরপুরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে।

পাটলাই নদীর পাড়ের গ্রাম দুধেরআউটার বাসিন্দা মো. মমরুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার নদীর মাঝে হয়ে গেছে বাঁধ। এর ফলে নদীর দুইপাড়েই চর পড়েছে। সীমান্তের কাছ থেকে নদী খনন করা হলে তাহলে কাজ করতে সুবিধা হবে।

বালিয়াঘাটের বাসিন্দা মোশাহিদ খাঁন স্বপন বলেন, অবৈধ বাঁধের কারণে নদীর স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়ে গেছে। চর ভেসে গেছে। আমরা দেখেছি নাব্যতা হারানো অনেক নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অথচ আমাদের পাটলাই নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীকে হত্যা করা হয়েছে। বাঁধ অপসারণ করে নদী খননের দাবি জানান তিনি।

সুনামগঞ্জ কৃষিপ্রধান এলাকা। এখানকার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে হাওরকে কেন্দ্র করে। নদীতে এ রকম বাঁধ দিয়ে পানির স্বাভাবিক গতিরোধ করায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে জেলার মানুষ। তাই যারা বাঁধ দিয়ে সড়ক তৈরি করেছে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি করছেন সচেতন মানুষ।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এনাম আহমদ বলেন, তাহিরপুরে পাটলাই নদীতে প্রভাবশালী মহল নদীতে বাঁধ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করছে। কোনো নদীর যদি স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয় একদিকে চর পড়বে, নদী ভাঙন হবে, গ্রাম বিলীন হবে। স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়ে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থাও ব্যাহত হবে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের ধান উৎপাদনে।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, নদী খননের দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছি। কোনোভাবেই নদীতে বাঁধ দেওয়া যায় না। এই কাজ সম্পূর্ণ পরিবেশবিরোধী। এই অধিকার কারো নেই। নদী খনন করতে হবে। তাই নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে এই বাঁধ যেন কেটে দেওয়া হয়।

সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের (সুপা) সাধারণ সম্পাদক মলয় চক্রবর্ত্তী রাজু বললেন, বাংলাদেশের নদ-নদীর সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে নদী একটি জীবন্ত সত্তা। নদীর দখল, অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে কাজ করা আইনবিরোধী। পাটলাই নদীতে বাঁধ দেওয়ায় পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণ হচ্ছে। বাঁধ অপসারণের জন্য প্রশাসনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছেন তারা।

তাহিরপুর কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি আলকাছ উদ্দিন খন্দকার বললেন, আগে নদীতে বাঁধ দেওয়া হতো। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসায় পরে ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর প্রায় ৬ বছর কয়লা আমদানি-রফতানি বন্ধ ছিল। এখন নদীতে পানি নেই, বিকল্প কোনো রাস্তা না থাকায় নদীর মাঝ দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা এলসির পাথর ও কয়লা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে হচ্ছে। এতে এলাকার মানুষদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির বললেন, পাটলাই নদীর ড্রাম্পের বাজার এলাকায় নদীর শুকনো অংশে বাঁধের ব্যাপারে জানা ছিলো না। এখন খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে একটি বাঁধ দেওয়া হয়। তবে সেটা সরেজমিনে দেখার দরকার আছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতের দরকার রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমএসআর