রংপুর অঞ্চলে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। এতে বিপাকে পড়েছেন অসহায়, দুস্থ ও ছিন্নমূল মানুষেরা। কনকনে শীতে খড়কুটো জ্বালিয়ে কেউ কেউ চেষ্টা করছেন শীত নিবারণের। আর এতেই অসাবধানতাবশত ঘটছে আগুনে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা। আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে গত ১১ দিনে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৪ জন।

রংপুরসহ আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে আসা অগ্নিদগ্ধ বিভিন্ন বয়সী শিশু ও নারীদের হাসপাতালের বার্ন  ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসাধীন ২৪ জনের মধ্যে সবশেষ দুই দিনে ভর্তি হয়েছেন আটজন দগ্ধ রোগী। এর মধ্যে এক বৃদ্ধাসহ দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

দগ্ধ রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে এক সপ্তাহ ধরে শীতের তীব্রতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। শীত নিবারণে গ্রামাঞ্চলে খড়কুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহানোর প্রবণতা বেড়েছে। আগুন পোহাতে গিয়েই সতর্কতার অভাবে অনেকে দগ্ধ হয়েছেন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেশির ভাগ দগ্ধ রোগী নারী ও শিশু। বার্ন ইউনিটে এসব রোগী এখন পোড়া ক্ষতের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।

বার্ন ইউনিটে কথা হয় নুর আলম নামে এক যুবকের সঙ্গে। নীলফামারীর ডোমার উপজেলা থেকে মাকে নিয়ে এসেছেন তিনি। অগ্নিদগ্ধ মায়ের উন্নত চিকিৎসা নিয়ে চিন্তিত নুর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাড়িতে আগুন পোহানোর সময় আমার মা সাহেদা খাতুনের পরনের কাপড়ে আগুন ধরে যায়। এতে তার শরীরের ৬০ ভাগেরও বেশি দগ্ধ হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে এখনো ঢাকায় নিতে পারিনি। 

একই ইউনিটে দগ্ধ শরীর নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা যায় সামসুন্নাহারকে। ৫৫ বছর বয়সী এই নারী রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বাসিন্দা। গত শনিবার (১ জানুয়ারি) সকালে বাড়িতে চুলায় আগুন পোহাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত দগ্ধ হন তিনি। শাড়ির পেছনে আকস্মিকভাবে ধরা আগুনে শরীর ঝলসে গেছে বলে জানান তার মেয়ে রাজিয়া সুলতানা।

কুড়িগ্রামের নদীবেষ্টিত রৌমারী উপজেলার চরাঞ্চল থেকে আসা দগ্ধ তসলিমা জানান, তার শরীরের হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত ৪০ ভাগ পুড়ে গেছে। 

একই কথা জানালেন, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার লালদিঘী ফতেপুর গ্রামের মমতাজ উদ্দিন। তার ১০ বছরের শিশু সালামের পাসহ শরীরে বিভিন্ন অংশ দগ্ধ হয়েছে। খড়খুটো জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে গেলে তার পরনের চাদরে আগুন ধরে যায়। 

বার্ন ইউনিটের এক বেড থেকে আরেক বেড ঘুরে এসে এক বৃদ্ধাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন রুপালী বেগম। কাছে গিয়ে জানা গেল ওই বৃদ্ধা তার শাশুড়ি। তারা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে চিকিৎসাসেবা নিতে রংপুরে এসেছেন। 

ঢাকা পোস্টকে রূপালী বেগম বলেন, ফজরের নামাজ পড়ার পর বাড়ির বাইরে আগুন পোহাতে গিয়ে আমার শাশুড়ির শাড়ির পেছনে আগুন লাগে। আগুনে তার শরীর ঝলসে গেছে। প্রথমে তাকে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। 

বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন বেশির ভাগ রোগীই শীতের তীব্রতা থেকে উষ্ণতা পেতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রতিদিনই রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ইউনিটে রোগী ভর্তি হচ্ছে। গত বছর শীত মৌসুমে ২৫ জনের বেশি নারী দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন।  

রমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. এম এ হামিদ পলাশ বলেন, শীতের সময় রংপুর অঞ্চলে আগুন পোহাতে গিয়ে অসাবধানতার কারণে নারী ও শিশুরা বেশি দগ্ধ হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ২৪ জন নারী-পুরুষ ও শিশু চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে দুজন বৃদ্ধার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা তাদের ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তারা যেতে রাজি হননি। সে কারণে এখানেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মঙ্গলবার রংপুর জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াতে ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। হিমেল বাতাস আর ঘন কুয়াশা শীতের তীব্রতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে জানুয়ারিতে তিনটি শৈত্যপ্রবাহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গেছে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর