রংপুরে পৌষের শেষে বাড়ছে শীত। ঘন কুয়াশার সঙ্গে বইছে হিমেল বাতাস। ঋতু পরিবতনের সঙ্গে জেঁকে বসা শীতে নাজেহাল বয়স্কদের সঙ্গে শিশুরাও। উষ্ণতা পেতে ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষের শরীরে উঠছে মোটা কাপড়। আগুন জ্বালিয়েও শীত নিবারণ করতে দেখা যাচ্ছে নিম্নবিত্তদের।

এদিকে শিশুদের মধ্যে শীতজনিত রোগ নিউমোনিয়া, ঠান্ডাজনিত ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর-সর্দিসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যা। চলতি জানুয়ারিতে এই অঞ্চলে তিনটি শৈত্যপ্রবাহের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ দিনে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবার বয়স ১ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে। শিশু ওয়ার্ডের প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে শিশুদের রাখা হয়েছে। শয্যার অভাবে খোলা হয়েছে ডায়রিয়া ইউনিট। সেখানে ১০টি শয্যা থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ৮টি।

হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নার্স ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শিথিলা খাতুন জানান, এবার কোল্ড ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ভর্তির তালিকা বাড়তে থাকায় চাপও বেড়েছে। চাপ সামলাতে অতিরিক্ত ডায়রিয়া ইউনিট খোলা হয়েছে। তাতেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তিনি শিশুদের পেস্ন সেন্টারকে ডায়রিয়া ইউনিট খোলার দাবি জানান। সেখানে ৫০টি শয্যার ব্যবস্থা হলে চাপ সামলানো যাবে বলেও জানান তিনি। বর্তমানে পেস্ন সেন্টারটি অচল হয়ে পড়ে আছে।

হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাই বেশি। গেল ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে হাসপাতালে প্রায় ১৩০০ শিশু ও বয়স্ক রোগী ভর্তি হয়। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৫ শতাধিক শিশু চিকিৎসাধীন রয়েছে।

শিশু ওয়ার্ডে তিন বছরের কন্যা শিশুকে নিয়ে এসেছেন নূর বানু। নগরীর পশ্চিম বাবুখাঁ এলাকার এই নারী জানান, তার মেয়ের কয়েক দিন ধরে সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। শীতে ঠান্ডার কারণে এ অবস্থা হয়েছে বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে জনবল সংকটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দুই চিকিৎসক। সেখানে দুজন মেডিকেল কর্মকর্তা ছাড়া রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার, আবাসিক চিকিৎসক ও সহকারী অধ্যাপক পদের কোনো চিকিৎসককে দেখা যায়নি। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা বলছেন, দুজন চিকিৎসকের একজন রোগী দেখছেন, অন্যজন ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। এই বিভাগে ৫ থেকে ৭ জন চিকিৎসককে দায়িত্ব পালন করলে দুর্ভোগ কম হতো।

হাসপাতালের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের একটি শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার শালঝোড় গ্রামের মতিন মিয়ার ১ মাস বয়সী নবজাতক। সেখানে একই জেলার পাটেশ্বরী থেকে এসেছেন হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী সুমাইয়া বেগম। তিনি এক সপ্তাহ ধরে তার ২ বছর বয়সের ছেলে সন্তানের চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বজনরা জানান, ডায়রিয়া ও খিঁচুনি রোগে আক্রান্ত হয়ে তাদের সন্তান ভুগছে। কষ্ট করে হলেও সন্তানকে বাঁচাতে তারা দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন।

শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. এস এম নুরুন্নবী বলেন, উত্তরাঞ্চল শীতপ্রবণ হওয়ায় এই সময়ে শীতজনিত রোগের প্রকোপ অনেকটা বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে শিশু ও বয়স্কদের ওপর। তাই রোগ প্রতিরোধে শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি গরম কাপড় ও উষ্ণতার পরামর্শ দেন তিনি।

রমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. রেজাউল করিম জানান, প্রচণ্ড শীতের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে শিশু ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, শীতে শিশুদের চাপ একটু বেশি থাকলেও এটাই স্বাভাবিক চিত্র। এমনিতেই প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন মারা যায়। এ ক্ষেত্রে শিশুরাও মারা যেতে পারে। তবে রোগীর স্বজনরা যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে এলে অনেককে সুস্থ করা সম্ভব হতো। তখন মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ অঞ্চলে তাপমাত্রা কমে শৈত্যপ্রবাহ বাড়বে। এ ছাড়া এখন ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। চলতি মাসে শীতের তীব্রতা বাড়ার পাশাপাশি কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ