সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার
আবু সাঈদ খান
বরেণ্য সাংবাদিক, লেখক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ খানের ৭০তম জন্মদিন ছিল সোমবার (০১ ফেব্রুয়ারি)। দৈনিক সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক তিনি। রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও লেখালেখির মাধ্যমে সুদীর্ঘ জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দিয়ে চলেছেন আবু সাঈদ খান।
এককথায় আলোর দিশারি তিনি। জন্মদিন উপলক্ষে এই গুণীজনকে শুভকামনা ও অভিবাদন জানায় ‘ঢাকা পোস্ট’ পরিবার। একই সঙ্গে ‘ঢাকা পোস্ট’ পরিবারকে শুভেচ্ছা জানান আবু সাঈদ খান।
বিজ্ঞাপন
৭০তম জন্মদিনে শৈশব থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন আবু সাঈদ খান। তার স্মৃতিচারণ তুলে ধরছেন আমাদের ফরিদপুর প্রতিনিধি বি কে সিকদার সজল।
ঢাকা পোস্ট: আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ৭০ বছরে পদার্পণের শুভক্ষণে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
বিজ্ঞাপন
আবু সাঈদ খান: ধন্যবাদ। শৈশব ও কৈশোরে বয়স বাড়ায় খুশি হতাম এই ভেবে, বড় হচ্ছি। এখন প্রতিটি জন্মদিনে মনে হয়; জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। কারণ অনেক কাজ এখনো বাকি। জন্মদিন আমার কাছে হিসাব-নিকাশের দিন, সামনের বছরের পরিকল্পনা গ্রহণের দিন; এর বাইরে কিছু নয়।
ঢাকা পোস্ট: বয়সের হিসাবে নয়, জীবন সম্পর্কে সার্বিক মূল্যায়ন কীভাবে করেন?
আবু সাঈদ খান: জীবন মানে ছুটে চলা। এই ছুটে চলার মাঝে আনন্দ-বেদনা দুটোই আছে। আনন্দ উপভোগ করি। দুঃখ-কষ্টের মাঝে সংবেদনশীল হওয়ার চেষ্টা করি। ব্যক্তি জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও সমাজ জীবন প্রবাহমান। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছুটে চলছি। এই ছুটে চলার প্রক্রিয়া-রিলে রেসের মতো। আমাদের সব অর্জন সন্তানদের কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে দিয়ে ‘গুডবাই’ বলতে হবে। আমরা যখন থাকব না, তখনো কর্ষিত জমিনে ফসল ফলবে; আমাদের সাজানো বাগানে ফুল ফুটবে, পাখিরা ওড়াউড়ি করবে। সেটি ভেবে আনন্দ পাই, মুত্যুকে ভয় পাই না।
ঢাকা পোস্ট: আপনি দীর্ঘ সময় রাজনীতি করেছেন, রাজনীতির সেকাল-একালের মধ্যে কি ধরনের পার্থক্য দেখতে পান?
আবু সাঈদ খান: ষাটের শেষার্ধে সংগ্রামের মিছিলে যাই। তখন দুনিয়াজোড়া পরিবর্তনের হাওয়া। চীন, রাশিয়া, পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ চলছে। কিউবা ও ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্রের পতকা উড়ছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে মুক্তিসংগ্রাম চলছে। মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো, জওহরলাল নেহেরু, শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে, জামাল আবদেল নাসেরের মতো জাতীয়বাদী নেতারা সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
আমরা তখন রূপকথার মতো ভ্লাদিমির লেনিন, মাও সে তুং, ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিনের গল্প পড়ছি। স্বপ্ন দেখতাম, পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। সাম্য মানবিক বিশ্ব আমাদের দোরগোড়ায়। তখন আমি আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কর্মী। আমরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত। কিন্তু সমাজতন্ত্রের প্রতিও ছিল অগাধ বিশ্বাস। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগও তখন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা জোরেশোরে বলে। তখন রাজনীততে স্বপ্ন ও আদর্শ দুই ছিল, ত্যাগের মানসিকতা ছিল, সুবিধাবাদীদের ওপর ঘৃণা ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর পৃথিবীতে উল্টো হাওয়া বইছে। খোলাবাজার অর্থনীতির জয়জয়কার। এর প্রভাব রাজনীতিতে পড়েছে। রাজনীতিও কারবারে পরিণত হয়েছে। মনোনয়ন বাণিজ্য ও পদবাণিজ্য চলছে। টাকা দিয়ে মনোনয়ন কেনা যায়, দলের বড় পদ কেনা যায়। এমপি-মন্ত্রী-জনপ্রতিনিধি বা দলের নেতা হয়ে কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হওয়া যায়। এই খেলায় কালো টাকার মালিক রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছেন। সৎ, মেধাবী, ত্যাগীরা ছিটকে পড়েছেন বা কোণঠাসা হয়ে আছেন।
ঢাকা পোস্ট: সমাজে বিরাজনীতিকরণের যে ধারা চলছে, বর্তমান রাজনীতিতে যেভাবে মেধাহীনদের আধিপত্য বাড়ছে, এর থেকে উত্তরণের পথ কী?
আবু সাঈদ খান: বিরাজনীতিকরণের পেছনে আমলা ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্র আছে। তবে তা সম্ভব হচ্ছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও বাণিজ্যিকায়নে জন্য। দুর্বৃত্তদের রাজনীতিতে দেখে মানুষ হতাশ হচ্ছে। ফলে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া সহজতর হচ্ছে।
দুর্বৃত্তরা মেধার চর্চা করে না, দরকারও পড়ে না। তারা অস্ত্রবাজি করে। ফলে মেধাবী ও আদর্শবাদীরা রাজনীতিতে আসছে না। এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চাই আদর্শবাদী রাজনীতি। বামদের সক্রিয় হতে হবে। ক্ষমতার ভেতরে ও বাইরের দলগুলোর মধ্যেও শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে রাজনীতি রাজনীতিকদের হাতে থাকবে না। তখন আমলারা হয়ে উঠবে রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ামক শক্তি। যেমনটি হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ অনুসরণ করতে পারে না।
ঢাকা পোস্ট: আপনার নিজ এলাকা ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বিভাগদি গ্রামে কলেজ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই দুরূহ কাজটি আপনি কীভাবে সম্পন্ন করলেন?
আবু সাঈদ খান: কাট শুরু করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পৈতৃক জমি। ভাই-বোনেরা সেটি দিতে রাজি হলো। সেখানে টকশোর জমানো টাকায় স্কুলঘর তোলার কাজ শুরু করলাম। স্বজনরা সহযোগিতা করেন। মা বেঁচে ছিলেন, তিনি তার শখের মেহগনি গাছগুলো দিয়ে দিলেন। তা দিয়ে ঘরের সাজসরঞ্জাম হলো। এভাবে রিজিয়া রশীদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘর হলো, তিন চার বছরের মধ্যে সরকারি হলো।
সালথা, বোয়ালমারী ও ফরিদপুর সদর; এই তিন উপজেলার কেন্দ্রস্থলে আমাদের গ্রাম বিভাগদী। অর্থাৎ তিন উপজেলার সীমান্ত এখানে মিলেছে। ১০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে কোনো কলেজ নেই। ধনী পরিবারের সন্তানেরা শহরে গিয়ে পড়ে। দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের সুযোগ হয় না।
বিশেষ করে মেয়েরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় না। সেটি বিবেচনা করেই কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। কাজটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। পৈতৃক ও মায়ের কাছ থেকে পাওয়া জমি মিলে ৫০ শতাংশ। কলেজ করতে দরকার এক একর অর্থাৎ ১০০ শতাংশ জমির। তাই কয়েক বছরের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরও ৫০ শতাংশ জমি কিনলাম; টকশোর টাকা দিয়ে প্রাথমিক খরচ মেটালাম। একটি ভবন করার জন্য ৫০-৬০ লাখ টাকা কে দেবে? স্বজন, বন্ধু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের কাছে হাত পাতলাম। বেশির ভাগই সহযোগিতার হাত বাড়ালেন। তাদের সহযোগিতায় ভবন হয়েছে, আরও এক একর জমি কেনা হয়েছে। এখন কলেজে বড় খেলার মাঠ হয়েছে। তবে কলেজটি এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি এখনো সহযোগিতা করছেন।
ঢাকা পোস্ট: শিক্ষার হার বাড়ছে, তবে মান কমছে; এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আবু সাঈদ খান: প্রথমে বলব, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অনেক স্কুলে অঙ্ক ও ইংরেজির শিক্ষক নেই। ভালো বেতন না দিলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসবেন না। এসব ভাবতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও করা দরকার। করোনায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছেন। তাদের সবাই কাজ পাবেন না। এসব কর্মহীন মানুষ ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে উৎসাহী হবেন না। তাই তাদের সন্তানদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে হবে, শিক্ষাবৃত্তি বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে; মানবসম্পদ দেশের বড় সম্পদ। তার উন্নয়ন ভিন্ন না হলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না আমরা।
ঢাকা পোস্ট: আপনি বহু বছর সাংবাদিকতা করেছেন, বই লিখেছেন অনেক। নানা ক্ষেত্রে বিচরণ। এখন কি মনে হয়, আপনি আরও করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি?
আবু সাঈদ খান: ব্যক্তি জীবনের চাওয়া-পাওয়া একান্ত নিজের। তারপরও বলব, না পাওয়া আছে। তবে তা নিয়ে গ্লানি নেই। ষাটের দশকে আমরা স্বাধীনতা চেয়েছি, একাত্তরে অর্জন করেছি। স্বাধীনতার পর আমরা সমাজটা বদলাতে চেয়েছি। সেই সংগ্রাম পিছিয়ে যাওয়ার কষ্ট আছে। পরবর্তীতে তা নতুন করে দানা বাঁধবে। সবুজ সংকেতও পাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট: আপনি লেখালেখি করেছেন নানা বিষয়ে। এখন কি বিষয়ে লিখছেন?
আবু সাঈদ খান: ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিসংগ্রাম ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র’ নামক একটি বই শেষ করেছি। ‘সেনাছাউনিতে মুক্তি সংগ্রাম ও আগরতলা মামলা’ শেষ পর্যায়ে। ‘স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি’র দ্বিতীয় সংস্করণের কাজও করছি।
ঢাকা পোস্ট: আপনি প্রধানত; মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখেন এবং বলেন। শোষণ বঞ্চনাহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে আদর্শের জন্য আপনি লড়াই করে চলছেন তার ছাপ আপনার মতামতে প্রতিফলিত হয়। এ ব্যাপারে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
আবু সাঈদ খান: একা সুখী হওয়া যায় না, সুন্দর জীবন পাওয়া যায় না। তাই সবার কথা ভাবতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাসযোগ্য সমাজ চেয়েছি। তা বাস্তবায়নের ভার এখন নতুন প্রজন্মের।
ঢাকা পোস্ট: একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পর বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আবু সাঈদ খান: দ্বিমতের সুযোগ নেই। আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছি। নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আছে। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। তবে উন্নয়নের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। দেশের সম্পদের সিংহভাগ শতকরা ৫-১০ ভাগ মানুষের দখলে। ৯০ ভাগই বঞ্চিতের দলে। এর মানে দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসাই হোক মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অঙ্গীকার।
ঢাকা পোস্ট: দেশ ও জাতির জন্য মূল্যবান এবং দিকনির্দেশনামূলক মতামত দিয়ে আপনি ঢাকা পোস্ট-এর পাঠকদের সমৃদ্ধ করেছেন, সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। শুভ জন্মদিন, আপনার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আবু সাঈদ খান: ঢাকা পোস্ট-এর সম্পাদক, সাংবাদিক-কর্মচারী ও পাঠকদের অনেক শুভেচ্ছা। ঢাকা পোস্ট পরিবারের জন্য শুভকামনা।
এএম