অগণিত মানুষের চোখের জল আর বিনম্র শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়ে মা-বাবার কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, প্রবীণতম আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক আদালতের সাবেক বিচারপতি তোফাজ্জাল হোসেন খান (টি এইচ খান)। 

মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুর আড়াইটার দিকে নিজ এলাকা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের বিলডোরার ঔটি গ্রামে চতুর্থ নামাজে জানাজা শেষে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।   

জানাজার আগে টি এইচ খানের বড় ছেলে সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল এইচ খান স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন। তার জীবনী তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনসহ নানা পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যরা। এর আগে উপজেলার হালুয়াঘাট সরকারি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তার তৃতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।   

জানাজা শেষে মরহুমের প্রতি ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ময়মনসিংহ-১ আসনের সংসদ সদস্য জুয়েল আরেং, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, হালুয়াঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ আব্দুর রশিদ, পৌর মেয়র খায়রুল ইসলাম ভূঁইয়া, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ শহীদ সারোয়ার, আবুল বাশার আকন্দ, ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু ওয়াহাব আকন্দ, উত্তর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সালমান ওমর রুবেলসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।   

রোববার (১৬ জানুয়ারি) বিকেল ৫টার দিকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০২ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। 

টিএইচ খান ১৯২০ সালের ২১ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলার ঔটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪২ সালে তৎকালীন কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ (অনার্স) ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৪৬ সালে এমএ পাস করেন।

১৯৪৭ সালে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। একই বছর ২৭ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সালেহ আকরামের নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারপতি নিয়ে ঢাকা হাইকোর্টের যাত্রা শুরু হয়, সেদিন থেকে বিচারপতি টিএইচ খান একজন আইনজীবী হিসেবে সেই আদালতে (বর্তমান সুপ্রিম কোর্টে) পদচারণা শুরু করেন। তিনি বিচারপতি টিএইচ খান নামে সমধিক পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম মো. তাফাজ্জাল হোসেন খান। 

১৯৬৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ১৯৭৩ সালের জুলাই থেকে আবার আইন ব্যবসায় ফিরে আসেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। 

১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর আইন, শিক্ষা, ধর্ম, ভূমি ও রাজস্ব এবং ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের নেতৃত্বে নতুন সামরিক আইন জারি করা হয়। তখন তিনি আবার আইন পেশায় ফিরে যান। ১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচনে বিরোধিতা করার জন্য তিনি গ্রেফতার হন। 

বিচারপতি টিএইচ খান ১৯৯২ সালে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিএনপির প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান। 

১৯৯২ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস কমিশনের মেম্বার এবং একই বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। 

১৯৯৫ সালে টিএইচ খান এশিয়া জোন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৯ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল পদে বিচারকার্য পরিচালনা করে দেশে ফিরে আসেন এবং আবার আইন পেশায় নিয়োজিত হন। 

আইন পেশা ছাড়াও বিচারপতি টিএইচ খান প্রথম জীবনে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, ঢাকার জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।

উবায়দুল হক/ওএফ