৩০ বছর আগে বড় ভাই ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে ঝগড়ার পর অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান সফিউল আলম। পরে পথ ভুলে হারিয়ে যান। পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি। ১৫ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া সেই সফিউল হঠাৎ তার ১৮ বছরের ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। নিখোঁজের ৩০ বছর পর বাড়িতে ফিরে আসায় সফিউলের পরিবার ও স্বজনদের মাঝে আনন্দের বন্যা বইছে। 

বুধবার (১৯ জানুয়ারি) রাতে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভুট্টোজোত পাঠানপাড়া এলাকায় বড় ভাই ইসামইল হোসেনের বাড়িতে ফেরেন সফিউল। এ সময় হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাইকে বড় ভাই ও ভাবিরা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। পাশাপাশি ছোটবেলার বন্ধুরাও মালা পরিয়ে সফিউলকে বরণ করে নেন।  

সফিউল আলম পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের ভুট্টোজোত পাঠানপাড়া এলাকার আকবর আলীর দ্বিতীয় ছেলে। কৃষক বাবার ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে সফিউল দ্বিতীয়। 

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৯২ সালে দরিদ্র কৃষক বাবার পরিবারে অভাব অনটন ও ভারপোষণ নিয়ে হঠাৎ করে সফিউল ও তার বড় ভাই ইসমাইল হোসেনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। পরে ভাইয়ের ওপর অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান সফিউল। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাসে উঠে চলে যান ঠাকুরগাঁও। সেখান থেকে দিনাজপুর, চট্টগ্রাম ও পরবর্তীতে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ফাসিয়াখালী ইউনিয়নের হাজিয়ান এলাকায় অবস্থান নেন। সেখানে এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ঠিকানা ও পথ ভুলে যাওয়ার তিনি আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। 

এদিকে সফিউলের পরিবার বিভিন্ন জেলায় খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পায়নি। সফিউল আর বেঁচে নেই বলে মনে করেছিল তার পরিবার। ছেলে হারানোর শোকে মারা যান সফিউলের মা সপিলা বেগম। 

জানা গেছে, ভাইয়ের ওপর অভিমান করে সফিউল ইসলাম বাড়ি থেকে বের হয়েই ঠাকুরগাঁওয়ে যান। সেখানে বেশ কয়েক দিন তিনি কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সহজ সরল হওয়ায় তেমন পারিশ্রমিক পেতেন না। পরে তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে চট্টগ্রামে গিয়ে রোলিং মিলে কাজ শুরু করেন। ভারী কাজ তেমন না পারায় পরিচিত একজনের সঙ্গে তিনি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় যান। সেখানে এক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে দীর্ঘ ১২ বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও তিনি পারিশ্রমিক পেতেন না। 

সাবেক চেয়ারম্যানের মৃত্যু হলে সেই বাড়িতে আর টিকতে পারেননি সফিউল। সেখান থেকে বের হয়ে আশপাশের এলাকায় কৃষি জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। স্থানীয়দের সহযোগিতায় তিনি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। সেখানে দীর্ঘদিন শ্রমিকের কাজ করার পরে স্থানীয়রা তাকে বিয়ে দেন। বিয়ের পর শ্রমিকের কাজ করে ১০ শতংশ জমি কিনে বাড়ি করেন। স্ত্রী সাকিলা বেগমসহ  তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার পরিবার ৷ 

সফিউল তার বাড়ির পথ না চিনলেও তিনি বলতেন ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এলাকায় তার বাড়ি। তার বড় ছেলে তাওহিদুল ইসলাম তাকে নিয়ে বাড়ির ঠিকানা খোঁজার জন্য বের হয়ে প্রথমেই পঞ্চগড় আসেন। তারা পঞ্চগড়ে বাস থেকে নামেন দশমাইল নামক এক বাজারে। সেই বাজারের কথা মনে পড়ে সফিউলের। তিনি তার বাবা-মা, ভাই কিংবা গ্রামের নাম বলতে না পারলেও বড় দুলাভাই ও বড় বোনের নাম বলতে পারতেন। পরে বাজারে দুলাভাইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে স্থানীয়রা তাকে দুলাভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে যান। এ সময় তার বড় বোন ও দুলাভাই সফিউলকে চিনতে পারেন। পরে ভাইদের খবর দিলে বড় ভাই ইসমাইল হোসেন তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। 

এদিকে ৩০ বছর আগে হারানো ছোট ভাইকে ফিরে পেয়ে আনন্দের শেষ নেই বড় ভাই ইসমাইল হোসেনসহ পরিবারের। দীর্ঘদিন পর সফিউল বাড়িতে ফিরে আসায় এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে সফিউলকে দেখতে তার বাড়িতে ভিড় জমাচ্ছে অনেকে।  

স্থানীয় বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই বাপ-দাদাদের কাছে শুনে এসেছি সফিউল নামে আমাদের এক প্রতিবেশী হারিয়ে গেছেন। তিন দিন আগে হঠাৎ তিনি তার ছেলেকে নিয়ে ফিরে এসেছেন। 

সফিউল আলমের বড় ভাই ইসমাইল হোসেন বলেন, আমার মেজো ভাই আমার ওপর অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি আমরা। কিন্তু তার সন্ধান আমরা পাইনি। আজ হঠাৎ করে আমার আদরের ভাইকে খুঁজে পেয়ে আমি অনেক আনন্দিত। 

৩০ বছর পর বাড়ি ফিরে সফিউল আলম বলেন, অনেক চেষ্টা করছি বাড়িতে আসার জন্য কিন্তু ঠিকানা বলতে বা পারায় আমি আসতে পারিনি। ছেলে-মেয়েদের জন্মসনদের কাগজপত্র প্রয়োজন তাই সাহস করে আমার বড় ছেলে প্রথম আমাকে পঞ্চগড়ে নিয়ে আসে। এখানে এসে দশমাইল বাজারের কথা লোকজনের কাছে শুনতে পাই। পরে মনে পড়ে ওই এলাকার আমার বড় বোনের বাড়ি। পরে বাসে উঠে ওই বাজারে গিয়ে আমার দুলাভাইয়ের নাম বললে মানুষজন তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমার বোন ও দুলাভাইকে আমি চিনতে পারি। তারাও আমাকে চিনতে পারে। পরে আমার বড় ভাই আমাকে বোনের বাড়ি থেকে পৈতৃক ভিটায় নিয়ে আসে। 

তিনি বলেণ, আমি অনেক আনন্দিত আজ আমার হারানো ভাই-বোনকে পেয়েছি। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু ঘরবাড়ি তৈরি করার মতো সামর্থ্য নেই। সরকার যদি সহযোগিতা করতো, তাহলে আমার অনেক উপকার হতো। 
 
সফিউলের বড় ছেলে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমার বাবা ছোটবেলায় হারিয়ে গেছেন- এটা আমাদের বলতেন। তিনি একেক সময় একেক জেলায় তার বাড়ির কথা বলায় আমরা খোঁজার চেষ্টা করিনি। আমাদের ভাই-বোনদের জন্মসনদের প্রয়েজন হওয়ায় বাবাকে নিয়ে পঞ্চগড়ে এসে খোঁজখবর নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ির সন্ধান পাই। অনেক ভালো লাগছে দাদার বাড়িতে এসে।  

এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সলেমান আলী বলেন, নিখোঁজ হওয়ার ৩০ বছর পর সফিউল নামে এক ব্যক্তি তার বাড়িতে ফিরে এসেছেন- এমন খবর পেয়ে প্রথমে গ্রাম পুলিশ ও পরে আমি ভুট্টোজো পাঠানপাড়া এলাকায় যাই। পরে সফিউল ইসলাম ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি- তিনি হারিয়ে যাওয়া সেই সফিউল। সফিউল যদি স্থায়ীভাবে তার পৈতৃক ভিটায় বসবাস করতে চান, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। 

 রনি মিয়াজী/আরএআর