ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধনে উপস্থিত হন শতবর্ষী ফিরোজা বেগম

ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে দিনের পর দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হয়ে, আদালতে অপেক্ষা করে ক্লান্ত শতবর্ষী ফিরোজা বেগম। জীবনের শেষ কোনো ইচ্ছে নেই এই বৃদ্ধার। শুধু ছেলে হত্যার বিচারের খবরটা শুনে মারা যেতে চান। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ফিরোজার কথা স্পষ্ট নয়, স্বর আটকে যায় ছেলে জাসদ নেতা সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের কথা মনে পড়লে। মূর্ছা গিয়ে পরে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বরিশালের বানারীপাড়া শহীদ মিনার চত্বরে ছেলে হত্যার বিচার চাইতে এসেছিলেন ফিরোজা।

তিনি বলেন, ‘আমার চউখে পচন ধরছে, আমার বাবার (ছেলে) খুনের বিচার চাইয়া কাঁনতে-কাঁনতে। গেদু আমার শ্যাষ ইচ্ছা, আমার পোলার খুনিদের বিচারের খবরডা হুইন্যা মরমু।’ 

নিহত সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের পরিবারের উদ্যোগে বরিশালের বানারীপাড়া শহীদ মিনার চত্বরে আয়োজিত মানববন্ধনে এসব কথা বলেন ফিরোজা বেগম। দীর্ঘ সাত বছরে ধরে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন জনের কাছে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে কেঁদে আসছেন তিনি। 

নিহত সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের ভাই সৈয়দ তরিকুল ইসলাম আপনুর বলেন, কোনো বিরোধ ছাড়াই আমার ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে মিন্টু, টুকু, সালাম, রঞ্জু ও ফিরোজ। আমার ভাই সৎ মানুষ ছিলেন। রাজনীতি করে অনেক সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন উপজেলা জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক। খুনিরা প্রতিহিংসার কারণে আমার রোজাদার ভাইকে জুমার নামাজের আগে কুপিয়ে হত্যা করে পথের কাটা দূর করেছিল।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, জিয়াউল হক মিন্টু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। নৌকা মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে শুনেছি। আরেক খুনি মজিবুল ইসলাম টুকু চাখার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। খুনি সালাম হাওলাদার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাকি খুনিরাও এদের ছত্রছায়ায় আছেন। চার্জশিটে তারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু জামিন নিয়ে এসে আমাদের আবারও হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিচার পাবো কি-না তা নিয়ে সংশয়ে আছি। 

সৈয়দ তরিকুল ইসলাম বলেন, ওরা আওয়ামী লীগের লোক না। ওরা খুনি। ওদের ফাঁসি চাই।

মামলার আইনজীবী আনিচুর রহমান বলেন, মামলা পরিচালনা করি বলে খুনিরা আমার পরিবারকেও হয়রানি করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় আমাকে হুমকি দিচ্ছে যেন মামলায় না লড়ি। হত্যাকারীরা জানে মামলা শেষ পর্যন্ত গেলে তাদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা চাই ক্ষমতার মুখোশে থাকা এইসব খুনিদের ফাঁসি হোক। একই সাথে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো আসামিদের জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তার করার দাবি জানান এই আইনজীবী। 

মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন মামলার সাক্ষী মো. জাফর আলী, নিহতের বোন আইনুন নেছা, আক্তারুন নেছা ও ভাই সৈয়দ কায়কোবাদ।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই সৈয়দ হুমায়ুন কবির উপজেলার মাদারকাঠী গ্রামের বাড়ি থেকে চাখার ওয়াজেদ মেমোরিয়াল উচ্চ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যান। এ সময় তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে চাখার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মজিবুল ইসলাম টুকুর মাদরকাঠী বাসস্ট্যান্ড মার্কেটের নিচ তলায় আটকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

মামলার তদন্তে উঠে এসেছে, বর্তমান মেয়র প্রার্থী জিয়াউল হক মিন্টুর নেতৃত্বে ওই মার্কেটে আটকে দা, হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। খুনিরা সৈয়দ হুমায়ূন কবিরের পায়ের ও হাতের রগ কেটে দেন। হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে, অণ্ডকোষ থেতলে, মাথায় উপর্যুপরি কুপিয়ে আহত করেন। খবর পেয়ে স্বজনরা টুকুর মার্কেট থেকে আহত হুমায়ূনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান তিনি।

পরদিন ২০ জানুয়ারি সৈয়দ হুমায়ুন কবিরের ছোট ভাই সৈয়দ তরিকুল ইসলাম আপনুর বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) সনজিৎ কুমার ওই বছরের ২৩ অক্টোবর জিয়াউল হক মিন্টু, মজিবুল ইসলাম টুকু, আব্দুস সালাম, রঞ্জু, ফিরোজসহ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন। আদালতে এখন পর্যন্ত এ মামলা ২৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর