আলো যেমন জাগতিক নিয়মে অন্ধকার দূর করে সবকিছু মূর্ত করে, তেমনি বই মানুষের মনে জ্ঞানের সঞ্চার করে যাবতীয় অন্ধকারকে দূর করে। সবকিছুকে উদ্ভাসিত করে চেতনার আলোয়। আবার আলো শুধু ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে; কিন্তু বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, কাছে থেকে দূরে, এক প্রান্ত থেকে দূরপ্রান্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলোকে পৌঁছে দেয়। তাই দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে জ্ঞানের স্ফূরণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র বই।

তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো।’ আর বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন– বই, বই এবং বই।’

তেমন চেতনা থেকে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের খামারপাড়া এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘জয় বাংলা’ পাঠাগার। এ পাঠাগারে পাওয়া দুষ্প্রাপ্য বইগুলো পড়ে খুশি স্থানীয় বইপ্রেমিকরা। অনেকে পাঠাগারে বসে জ্ঞান আহরণ করেন, আবার অনেকে বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।

গত ১৬ ডিসেম্বর পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন নবী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এটি উদ্বোধন করেন।

সরেজমিনে জয় বাংলা পাঠাগারে দেখা গেছে, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা পাঠাগারে বসে বই পড়ছেন। পাশাপাশি খবরের কাগজও পড়ছেন তারা। অনেকেই আবার পাঠাগারের সুন্দর অবয়ব দেখতে এসেছেন। এর ভেতর আলমারিতে সাজানো রয়েছে থরে থরে বই। পাঠাগারে আসা কেউ পড়ছেন একাত্তরের বই, কেউ গল্প-উপন্যাস, কেউ সাহিত্যিকের জীবনী, কেউ ভালোবাসার গল্প, কেউ বৈজ্ঞানিক কাহিনি।

মনোরম ও দৃষ্টিনন্দন পাঠাগারে রয়েছে সাতটি বুক সেলফ (আলমারি)। তাতে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে ৩১৫টি বই। এ ছাড়া আরও এক হাজার বই যুক্ত হবে পাঠাগারে। পাঠাগারটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েই বেশি বই সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের জীবনী, ভালোবাসার গল্প, বৈজ্ঞানিক কাহিনি ও রূপচর্চার বইও রয়েছে। রয়েছে ছোটদের গল্পের বই। বইয়ের পাশাপাশি টাঙ্গাইল জেলার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে।

জানা গেছে, একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন নবী ও তার সহধর্মিণী ড. জিনাত নবী গ্রামের বাড়ি খামারপাড়া এলাকায় জয় বাংলা পাঠাগারটি নির্মাণ করেন। ছোট একটি গ্রাম খামারপাড়া। এই গ্রামে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতেই নিজ উদ্যোগে ‘জয় বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করে ড. নূরুন নবী। উদ্বোধনের পর থেকেই স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে পাঠাগারটি।

ড. নূরুন নবী একজন লেখক ও বইপাগল মানুষ। তার প্রতিষ্ঠিত পাঠাগারের পাশেই রয়েছে একটি প্রাইমারি ও উচ্চবিদ্যালয়। ওই দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্কুলের পাশাপাশি বই পড়ায় মনোনিবেশ করে সেখানে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, গ্রামের অনেক শিক্ষিত তরুণ, যুবক ও বয়স্কসহ প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন আসেন বই পড়তে।

বই পড়তে আসা তরুণরা বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এত সুন্দর পাঠাগার হবে এবং তাতে দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যাবে, এটা ভাবিনি। কিছুদিন আগেও গ্রামের ছেলে-মেয়েরা মোবাইল গেমস ও বিভিন্ন সময় অপচয়মূলক কাজে জড়িয়ে পড়ত। কিন্তু পাঠাগার হওয়ায় ছেলে-মেয়েরা এখন এখানে বই পড়তে আসছে। বই পড়ে জ্ঞান লাভ করা যায়। অনেক বই আছে যেগুলোর নাম কখনো শোনাই হয়নি।

গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের সংগঠক ও অর্জুনা হাজী ইসমাইল খাঁ কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুস ছাত্তার খান বলেন, পাঠাগার হচ্ছে গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়। ছেলে-মেয়েরা সময়টাকে অপচয় করার জন্য খেলাধুলার জন্য মোবাইল গেমে আসক্ত হয়ে গেছে। এতে তারা দিগভ্রান্ত হয়ে গেছে। তাদের এই পাঠাগারের দিকে টেনে আনলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একটি করে পাঠাগার হোক।

তিনি আরও বলেন, এই প্রত্যন্ত গ্রামে এই পাঠাগারে অনেক নামকরা লেখকের বইয়ের পাশাপাশি ‘৭১র মুক্তিযুদ্ধসহ দুষ্প্রাপ্য অনেক বই রয়েছে। বইগুলো পড়ে অনেক ভালো লেগেছে। এই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পাঠাগারের বই পড়ে তাদের মানসিক বিকশিত হবে। ড. নূরুন নবী যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গ্রামে সুন্দর একটি পাঠাগার করেছেন, আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।

জয় বাংলা পাঠাগারের পরিচালক আশিকুর রহমান সোহাগ বলেন, প্রতিদিন জয় বাংলা পাঠাগারে প্রায় ২০ জন বই পড়তে আসে। শিক্ষার্থীরা যারা অবসরে মোবাইল গেমস, গল্পগুজব করে সময় কাটাত, তারা এখন পাঠাগারে গিয়ে বই পড়ছে। পাঠাগারে বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য জানার পাশাপাশি নামকরা অনেক লেখকের বই পড়তে পারছে। পাঠাগারে বর্তমানে তিনশর অধিক বই রয়েছে। আরও এক হাজার বই পাঠাগারে যুক্ত করা হবে। অনেকেই বই নিয়ে বাড়িতে পড়ছে।

জয় বাংলা পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন নবী বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই পাঠাগারটি করা হয়েছে। আমরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। পাঠাগারটির নাম জয় বাংলা রেখেছি এ জন্য যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে।

এনএ