হুমকির মুখে চাকমা পল্লী
কক্সবাজার জেলার টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং পুটিবনিয়া চাকমাপল্লীতে ২৮টি নৃগোষ্ঠী পরিবারের বসবাস। কিন্তু কাঁটাতারের ভেতর তারা ভালো নেই। খাদ্য, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, নিরাপত্তার অভাবসহ নানা সংকটে হুমকির মুখে এই চাকমাপল্লী।
চাকমাপল্লীর বাসিন্দা মংচিচা চাকমা (৮১)। তিনি জানান, কৃষি জমিতে চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু রোহিঙ্গা আসার পর থেকে তাদের কৃষি জমিতে ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। এতে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড পঙ্গু হয়ে গেছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে সহিংসতা ও অপহরণের ভয়ে নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারে না। রাত হলে ক্যাম্পের ভেতরের চিত্র পাল্টে যায়। ফলে তারা জুম চাষ করতে পারছেন না।
বিজ্ঞাপন
চাকমাপল্লীর বাসিন্দারা জানায়, ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল আমার ধানক্ষেতের পাশে টেকনাফের মিনাবাজার এলাকার স্থানীয় যুবক আকতার উল্লাহর গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়। এটা দেখার পর পল্লীর সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
কলেজছাত্র ছোটন চাকমা জানান, চার বছর আগেও রাতে কোচিং সেন্টার থেকে পড়াশোনা শেষ করে নির্ভয়ে বাসায় ফিরতে পারতাম। কোনো ভয় বা আতঙ্ক ছিল না। এখন দিনের আলোতেও ঘর থেকে বের হতে নিরাপত্তাহীনতায় থাকি। আগে পল্লীর প্রতি ঘর থেকে ২-৩ জন পড়ালেখা করত। কিন্ত সেটা এখন নেই বললেই চলে। শিশুরা ঝরে পড়ছে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর এই চাকমাপল্লীর চারপাশে গড়ে ওঠে ২২ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প। রোহিঙ্গা ক্যাম্প গড়ে তুলতে গিয়ে চাকমাদের বাঁশ বাগান, ফসলি জমি, পাহাড় সবকিছুই বিলীন হয়ে গেছে।
চাকমা জনগোষ্ঠী জানিয়েছে, এক সময় নদীতে ব্লক বসিয়ে বছরজুড়ে চাষ করতেন তারা। আর সেই চাষের ফসল বিক্রির জন্য উনচিপ্রাংয়ে বাজারও বসত। কিন্তু এখন চাষাবাদের সেই জমিতে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠেছে। দূষণের শিকার হয়ে নদীটিও এখন অস্তিত্ব সংকটে।
এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরের বর্জ্য ও মলমূত্রের কারণে উনছিপ্রাং রইক্যং বিশাল এলাকায় খাল ভরাট ও পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। চার বছর ধরে অনাবাদি হয়ে পড়েছে কৃষিজমিগুলো। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও স্থানীয়রা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে।
মংলা মো চাকমা (২৫) জানায়, আমরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। হালচাষে এই খালের পানি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা আসার পর চার বছর ধরে এই খালে বর্জ্য ফেলার কারণে এটি মরা খালে পরিণত হয়েছে। এ কারণে চাষ বন্ধ রয়েছে। এক সময় এ খালের পানিতে চাষাবাদ করে পুরো বছরের সংসার চলত। কিন্তু অবস্থা এমন হলে আমাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে না ।
রিগান চাকমা জানান, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এই খালে জোয়ার-ভাটা বন্ধ। অথচ খাল থেকে আমরা মাছ ও কাঁকড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতাম। গেল চার বছরে এই খালের জোয়ার-ভাটা দূরের কথা, পানি দূষিত হয়ে উল্টো দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এখন কৃষিকাজ বন্ধ থাকায় আর্থিকভাবে আমরা কষ্টে আছি। সংশ্লিষ্টদের জানানোর পরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে যায় মাছু চাকমার বাড়িটি। প্রশাসন এবং এনজিও সংস্থার পক্ষ থেকে পুড়ে যাওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাড়িগুলো পুনরায় নির্মাণ করে দেওয়া হলেও মাছু চাকমার বাড়িটি নির্মাণ করা হয়নি। বছর ধরে ক্যাম্প ইনচার্জ ও সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও এক টুকরো টিনও দেওয়া হয়নি তাকে। মাছু চাকমা এখন স্বামী সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে দিন যাপন করছেন।
মাছু চাকমা জানান, এখন ভিটের আঙিনায় গাছপালা রোপণ বা চাষাবাদ করলে সেগুলো লুট করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গারা। বাড়িতে প্রাপ্তবয়স্ক নারী থাকায় কোথাও গেলে সন্ধ্যে নামার আগেই ফিরতে হয় তাকে। রোহিঙ্গাদের ভয়ে আদিবাসী নারীরা বনে চাষাবাদ তো দূরের কথা ঠিকমতো বাড়ি থেকে বের হতে পারে না।
এই পল্লীর বাসিন্দা লামং জানান, তরুণীরা ঘর থেকে বের হতে পারে না। আগে নারীরা জুমে গিয়ে চাষ করতে পারতো কিন্তু রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এখন সব বন্ধ। এখন সবসময় জীবন নিয়ে শঙ্কায় থাকি।
চাকমা পল্লীর নেতা নিচামং চাকমা। এক বুক কষ্ট আর আক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তিনি জানান, অন্যান্য এলাকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী যথেষ্ট সহযোগিতা পেলেও তারা কোনো সহায়তা পাননি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। দায়িত্বশীলদের বাধার কারণেই এসব সংস্থার লোকজন চাকমাপল্লীতে ঢোকে না বলে অভিযোগ এই নেতার।
তিনি আরও বলেন, আমাদের চাষের জমি এখন রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প। জুম চাষ করতে যেতে পারি না রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ভয়ে। কখন আবার অপহরণ করে নিয়ে যাবে। অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, আমাদের বৃহত্তর উৎসবে ধর্মীয় গুরুরা আসতে পারেন না। তারা আসতে চাইলেও প্রশাসনকে কয়েকশ কাগজ দেখাতে হয়। এখন আবার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের হয়রানি করে।
এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ার আগে এই চাকমাপল্লীতে শিখন স্কুল ছিল। কিন্তু ক্যাম্প হওয়ার পর সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। এখন তাদের শিশুরা পড়াশোনাবিমুখ। রোহিঙ্গাদের ভয়ে শিশুদের একা কোথাও যেতে দেওয়া হয় না।
চাকমা জনগোষ্ঠীর দাবি, রোহিঙ্গাদের বসতি দীর্ঘস্থায়ী হলে জীবন-জীবিকার খোঁজে তারা উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। তাই সংকট উত্তরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী জানান, চাকমা পল্লীর সমস্যাগুলো আমাদের জানাতে হবে। আমাকে না জানালেও থানায় অভিযোগ করতে হবে। তবে আমরা এই পল্লীর বাসিন্দাদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ কাজ করে যাব।
সাইদুল ফরহাদ/এসপি