বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) খাল খনন ও সংস্কার কাজে অব্যবস্থাপনার কারণে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নওগাঁ সদর উপজেলার দুই ইউনিয়নের ১০০ একরের বেশি জমির ইরি-বোরো তলিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা।

কৃষকদের অভিযোগ, খাল খননে অব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের অভাবে পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে ধান। ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে ৪০ গ্রামের প্রায় ৫ হাজার কৃষক। এই বিষয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বার বার অভিযাগে করেও কোনো সমাধান হচ্ছে না। 

জানা গেছে, কৃষকদের সেচ সুবিধার জন্য ২০১৭ সালের শেষের দিকে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জলবায়ু ট্রান্সপ্লান্ট প্রকল্পের আওতায় মহাদেবপুর উপজেলার চকগৌরি থেকে শুরু করে সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের প্রতাপদহ থেকে হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়ন হয়ে নলমাড়া খাল পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার খাল খনন করে। 

এর মধ্যে সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের প্রতাপদহ থেকে হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের শিমুলা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার খাল খননে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। কোথাও কোথাও খাল খনন করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও খননের নামে মাটি উঁচু করে রাখা হয়েছে। এতে খালের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। আবার দীর্ঘ দিন সংস্কার না করায় কচুরিপানায় ভরে গেছে খাল। এতে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ফলে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে দুই ইউনিয়নের ভীমপুর, পাটাকাটা, প্রণইল, চকাদেব, বুদগাড়ী, হামরা, কৃষ্টপুর, চুয়ারপাড়া, চড়ই গোলাসহ প্রায় ৪০ গ্রামের কৃষকদের ৩০০ বিঘা জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। খালটি পুনরায় খনন করে নলামারা ব্রিজ পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করলে বৃষ্টির পানি সহজেই নেমে যাবে। তাহলে একমাত্র ফসল নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না কৃষকদের।

বলিহার ইউনিয়নের নিন্দুইন গ্রামের কৃষক মো. কায়েম সরদার বলেন, এই বিলে আমার ১০০ বিঘা সম্পত্তি। আমাদের এক ফসলি জমি। প্রতি বিঘা জমিতে ধান রোপণে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার খরচ হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এসব জমির ধানের আর আশা করা যাচ্ছে না। খাল ভালোভাবে খনন করা হয়নি। আর দীর্ঘদিন থেকে খাল সংস্কারের অভাবে খালজুড়ে কচুরিপানা জমে গেছে। এসব কারণে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। এতে করে আমার ৫ বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে।

প্রতাপদহ গ্রামের কৃষক একলাস বলেন, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দায়সাড়াভাবে খাল খনন করেছে। খালটি আরও গভীর করে খনন করার দরকার ছিল। এছাড়া প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধু মাটি ফেলে সামান্য গভীরতা করে খাল খনন করা হয়েছে। আবার কচুরিপানায় ভরে গেছে খাল। এতে পানি বের হতে পারছে না।

ভীমপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ সরদার বলেন, ভাইরে গরিব মানুষ আমি। ২৫ বিঘা জমিত ধান লাগাছনু। সেচ, সার, শ্রমিক, জমি তৈরিসহ প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হছে। এখন জমির সব ধান পানির নিচে তলা গেছে। এই ধানের আবাদ দিয়ে সারা বছর সংসার চলে। পুনরায় ধান আবার রোপণ করতে হবে। এই সময় ধানের চারা পামু না। এখন সংসার চলবে কেমনে? যেই খাল হামাকের উপকারের জন্ন্যি করা হচে সেই খাল আজ হামাকে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াছে।

পাটাকাটা গ্রামের কৃষক রায়হান আলী মন্ডর বলেন, ধারদেনা করে ৬ বিঘা জমিত ধান লাগাছনু। একন সব ধান পানিত তলা গেছে। কি করে খামু আর এই ধারদেনা শোধ করমু কি করে? হাতজোড় করে অনুরোধ করছু খালডা যেন দ্রুত সংস্কার করা হয়। হামাকোক এ্যানা বাঁচাও। তোমরা এ্যানা সরকারের কাছে হামাকে সমস্যাডা তুলা ধরো।

স্থানীয় হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন মোল্লা বলেন, কৃষকদের সুবিধার জন্য ২০১৭ সালের শেষের দিকে খালটি খনন করা হয়। খালটি খননের সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ১০ কিলোমিটার খাল খননে অর্ধেকই সঠিকভাবে খনন করা হয়নি। এছাড়া দীর্ঘ দিন খাল সংস্কার না করায় কচুরিপানা জমেছে পুরো খালে। এতে সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। খাল দিয়ে পানি ওভারফ্লো হওয়ায় ১০০ একর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় কৃষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। তাই আমরা এর প্রতিকার চাই।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নওগাঁ-১ অঞ্চলের নিবার্হী প্রকৌশলী শমসের আলী বলেন, মোট ৩৭ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছিল ২০১৭ সালের শেষের দিকে। এর মধ্যে দুবলহাটির প্রতাপদহ মাঠ থেকে হাঁসাইগাড়ীর নলামারা খাল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার খালের কিছু সমস্যার অভিযোগ পেয়েছি। তবে ৫ কিলোমিটার খাল খননে অনিমিয়মের কথা ঠিক নয়। একটি খাল খননের ৫-৭ বছর পর এমনিতেই ভরাট হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী খাল খনন করা হয়েছিল। আর খালে স্থানীয়রা মাছ চাষ করলে সেখানে বেড়া, খড়ি দেওয়ার কারণেও কচুরিপানা জমাট বাঁধতে পারে। তবে সার্বিক বিষয়ে আমরা তদন্ত করে দেখছি। তদন্ত সাপেক্ষে পুনরায় খাল খননের প্রয়োজন হলে প্রজেক্ট নিয়ে সেটার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

দেলোয়ার হোসেন/এসপি