জনকল্যাণমূলক সব কিছু এখন বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, আর তৃণমূলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব অধিকার সংকুচিত করা হচ্ছে। মানুষের সমস্যা ও চাহিদার কথা বাজেট প্রণয়নের সময় কেউ শুনতে চায় না।

শনিবার (২ এপ্রিল) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২৩ প্রস্তুতি আলোচনা: চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়’ শীর্ষক জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা বলেন, নিত্য পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে জরুরিভাবে টাকা-পয়সাকে মূল অভীষ্ট ধরে বাজেট প্রণয়নের প্রচলিত চিন্তা কৌশল থেকে সরে এসে মানুষের প্রয়োজনের নিরিখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, আইনজ্ঞ, রাজনৈতিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ, সমাজ উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সাংবাদিক নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি তাদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন।

সভাপতির বক্তব্যে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, শোভন অর্থনীতি ব্যবস্থায় মানুষের ন্যায়-অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যমই হলো রাষ্ট্রীয় বাজেট। সে কারণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ধারণার রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রচলিত অর্থের মূলধারার অর্থনীতিবিদদের ধারণার বাজেট থেকে পদ্ধতিগতভাবে ভিন্ন—সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। 

তিনি বলেন, বাজেট প্রণয়নে প্রচলিত অর্থনীতি শাস্ত্রের চিন্তা-ভিত্তিকেই আমরা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করি। প্রচলিত প্রথায় বাজেট প্রণয়নের শুরুটাই হয় ‘টাকা-পয়সাকে’ মূল অবজেক্ট অথবা উদ্দিষ্ট-লক্ষ্য-অভীষ্ট ধরে নিয়ে। বাজেট প্রণেতারা প্রথমেই যা ঠিক করেন, তা হলো ‘কত টাকা-পয়সা আছে’ অর্থাৎ রিসোর্স এনভেলপ। কিন্তু শোভন অর্থনীতি ব্যবস্থায় বাজেট প্রণয়ন কর্মকাণ্ডের শুরুটাই হবে ‘কত টাকা পয়সা আছে’ দিয়ে নয়—‘কী কী প্রয়োজন তা দিয়ে’ অর্থাৎ ‘এনভেলপ অব থিংস টু ডু’। যার মধ্যে থাকবে—মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কাজ, বিশ্রাম-বিনোদন, সংস্কৃতি চর্চা থেকে শুরু করে মানুষের সুস্থ-সৃজনশীল বিকাশের জন্য যা-কিছু প্রয়োজন—সবই। 

সভায় বক্তারা বলেন, দেশে নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু তা টেকসই করা যাচ্ছে না। সরকারি বাজেট প্রণেতা ও নীতিনির্ধারকদের ভেবে দেখা উচিত যে সবাই যেখানে উন্নতি করছে, সেখানে কেন এক বছরের ব্যবধানে ৯ ধাপ পিছিয়ে ২০২১ সালে বিশ্বসেরা ১০০ বন্দরের তালিকায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ৬৭তম স্থানে নেমে এসেছে। দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার গোড়াপত্তনকারী চট্টগ্রামের ৯০-এর দশকের ৪০ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি হিস্যা কমে এখন ১২‑১৩ শতাংশ হয়েছে?

তারা বলেন, এই একবিংশ শতকেও সুঁই থেকে শুরু করে অ্যারোপ্লেন পর্যন্ত—সবকিছুর জন্য কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। অথচ সংবিধানের ৯, ১১, ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় বিষয়াবলী পরিচালনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু জনকল্যাণমূলক সবকিছু এখন বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, আর তৃণমূলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব অধিকার সংকুচিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির চট্টগ্রাম‑চ্যাপ্টারের সভাপতি অধ্যাপক ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত বলেন, বাজেট প্রণয়নের আগে এনবিআর ব্যবসায়ীদের কথা শোনে, যারা নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কিত নানা দাবি-দাওয়া তুলে ধরতেই ব্যস্ত থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সমস্যা ও চাহিদার কথা বাজেট প্রণয়নের সময় কেউ শুনতে চায় না।

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, নীতিনির্ধারণী সবকিছু কেন্দ্রীকরণের কারণে রাজধানী ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ধরনের শিল্পের ঘনীভবন হচ্ছে। অথচ বিদেশে পণ্য রপ্তানির জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরই দেশের মূল ভরসা। আঞ্চলিক সম্ভাবনার আলোকে পরিকল্পনা করা হলে স্থানীয়ভাবেই নানা ধরনের উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হতো, যা দেশের উন্নয়নকে টেকসই রূপ দিত।

সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের বক্তারা পর্যটন শিল্পের বিকাশ, গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য অত্যাধুনিক জাহাজের ব্যবস্থা ও জলদস্যুতা রোধ,কক্সবাজার জেলাসহ সৈকত এলাকায় দখল‑দূষণ রোধসহ বেহাল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দাবি করেন বক্তারা।

আরএম/এসকেডি