দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বীমা চুক্তি হওয়ায় দেশের টাকা দেশেই থাকছে

বীমার আওতায় এসেছে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু। ক্ষয়-ক্ষতি ও ঝুঁকি কমাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি) পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এর আগে কখনও বড় বড় প্রকল্পের কোনো বীমা দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান পায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথমবারের মতো বড় প্রকল্পের বীমা দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়ায় এ খাতে আস্থা বাড়বে। পাশাপাশি দেশের অর্থ দেশেই থেকে যাবে।

বীমাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বকে তাক লাগিয়ে নিজেদের অর্থায়নে করা পদ্মা সেতুর বীমা নিজ দেশের প্রতিষ্ঠানের অধীন থাকা এ খাতের জন্য বড় অর্জন। অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বীমা খাতের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।

আগে বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে বীমা করার জন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ধরনা দিতে হতো। সেদিন পাল্টে যাচ্ছে। এখন আমরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারই প্রমাণ পদ্মা সেতুর বীমা— এমনটি মনে করছেন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন।

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে পদ্মা সেতু। এ প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার ৫২১ কোটি সাত লাখ ৬৮ হাজার ৩০৬ টাকার ঝুঁকি বীমা করা হয়েছে। যার প্রিমিয়াম দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি ৪১ লাখ ৫১ হাজার ৫০১ টাকা

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বঙ্গবন্ধু সেতুসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক মানের প্রকল্পগুলোর জন্য বীমা করা হতো দেশের বাইরের কোম্পানির সঙ্গে। এখন আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। দেশের সবধরনের সম্পদের বীমা হচ্ছে। পদ্মা সেতু তার উদাহরণ।’

আগে বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে বীমা করার জন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ধরনা দিতে হতো। সেদিন পাল্টে যাচ্ছে। এখন আমরা নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারই প্রমাণ পদ্মা সেতুর বীমা

ড. মোশাররফ হোসেন, চেয়ারম্যান, উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ

পদ্মা সেতুর জন্য ১৩ হাজার ৫২১ কোটি সাত লাখ ৬৮ হাজার টাকার ঝুঁকি বীমা করা হয়েছে

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ হচ্ছে। এ প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার ৫২১ কোটি সাত লাখ ৬৮ হাজার ৩০৬ টাকার ঝুঁকি বীমা করা হয়েছে। যার প্রিমিয়াম দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি ৪১ লাখ ৫১ হাজার ৫০১ টাকা। 

বড় প্রকল্পের বীমা করার সক্ষমতা আমাদের আছে জানিয়ে এসবিসির পুনঃবীমা বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বড় বড় প্রকল্পের এসবিসি করার মাধ্যমে সরকার একদিকে ক্লেইম (অভিযোগ) করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রিমিয়ামের অর্থ দেশেই থেকে যাচ্ছে। এসবিসির বড় প্রকল্পের বীমা করার সক্ষমতা আছে, পদ্মা সেতুর বীমাই তার বাস্তব উদাহরণ।’

এসবিসির তথ্য বলছে, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের সঙ্গে সংযুক্ত পদ্মা বহুমুখী সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। সেতুর ‘রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস’ (River Training Works) প্রকল্পের জন্য এর ক্ষয়-ক্ষতি আর ঝুঁকির কমাতে ১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বীমা পলিসির ইস্যু করা হয়। যা বাংলাদেশি টাকায় আট হাজার ৯০৫ কোটি ৯৭ লাখ ২৮ হাজার ৩০৬ টাকা। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৪ জুনে। এ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সাধারণ বীমা করপোরেশনকে ১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার প্রিমিয়াম দিয়েছে।

বড় বড় প্রকল্পগুলোর এসবিসি করার মাধ্যমে সরকার একদিকে ক্লেইম (অভিযোগ) করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রিমিয়ামের অর্থ দেশেই থেকে যাচ্ছে। এসবিসির বড় প্রকল্পের বীমা করার সক্ষমতা আছে, পদ্মা সেতুর বীমাই তার বাস্তব উদাহরণ

মো. জাকির হোসেন, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, এসবিসির পুনঃবীমা বিভাগ

একইভাবে সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে পদ্মার নদীর স্রোতরক্ষা এবং আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাট তৈরিতে ক্ষয়-ক্ষতি কমাতে ‘রিভার ট্রেনিং সিস্টেম অব বাথ ব্যাংকস’ (River Training System of both Banks) প্রকল্পের জন্য ৫৫ কোটি চার লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থের বীমা পলিসি ইস্যু করা হয়েছে। যা বাংলাদেশি টাকায় চার হাজার ৬১৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর চার হাজার ৬১৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকার বীমা করা হয়। যার মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ২৯ জুন। এজন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সাধারণ বীমা করপোরেশনকে ২৫ কোটি ৮৭ লাখ ১৭ হাজার ২৬৯ টাকার প্রিমিয়াম জমা দিয়েছে। অর্থাৎ দুটি প্রকল্পের জন্য প্রিমিয়াম দেওয়া হয়েছে ৪২ কোটি ৪১ লাখ ৫১ হাজার ৫০১ টাকা।

এসবিসির পদ্মা সেতুর বীমা করার মধ্য দিয়ে দেশের বীমা সেক্টর নতুন যুগের সূচনা করল। আশা করছি, বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসবে

শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, সাবেক চেয়ারম্যান, আইডিআরএ

বীমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বীমা খাত অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে। ভারতসহ অন্যান্য দেশে অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে খাতটি। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও ঝিমিয়ে আছে এটি। সরকারি বা বেসরকারি— দেশের সব সম্পদের ক্ষেত্রে বীমার প্রয়োজন কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতাকে দায়ী করা হচ্ছে।

মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৯২ শতাংশ, বলছেন সংশ্লিষ্টরা

সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন— মনে করেন আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসবিসির পদ্মা সেতুর বীমা করার মধ্য দিয়ে দেশের বীমা সেক্টর নতুন যুগের সূচনা করল। আশা করছি, বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ সেতু বিভাগের তথ্যানুসারে, পদ্মা সেতু চালুর পর দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ।

পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অগ্রগতি

গত ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ২ মিনিটে পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যান বসানো হয়। সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অহংকার ও সক্ষমতার পদ্মা সেতু পূর্ণতার পথে এগিয়ে যায় নতুনমাত্রায়। সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দেবে এ সেতু। একইসঙ্গে উন্নয়নের সূচকে যোগ করবে নতুন মাত্রা।

রাজধানীর দিলকুশায় সাধারণ বীমা করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়

বাংলাদেশ সেতু বিভাগের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৯২ শতাংশ, নদীশাসনের কাজ হয়েছে ৭৯ শতাংশ, জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ বহু আগেই পুরোপুরি শেষ হয়েছে। মূল সেতুর ২৯১৭টি রোড স্ল্যাবের মধ্যে ১৭৯১টি বসানো হয়েছে। এ কাজের অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। রেলওয়ে স্ল্যাবের ২৯৪৯টির মধ্যে ২৩২২টি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এক্ষেত্রে অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। প্রকল্পের ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ সেতু বিভাগের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ হয়েছে ৯২ শতাংশ, নদীশাসনের কাজ হয়েছে ৭৯ শতাংশ, জাজিরা ও মাওয়া সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ বহু আগেই পুরোপুরি শেষ হয়েছে। মূল সেতুর ২৯১৭টি রোড স্ল্যাবের মধ্যে ১৭৯১টি বসানো হয়েছে। এ কাজের অগ্রগতি ৬১ শতাংশ। রেলওয়ে স্ল্যাবের ২৯৪৯টির মধ্যে ২৩২২টি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এক্ষেত্রে অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। প্রকল্পের ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা।

আগামী বছর জুনের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। দেশীয় উপকরণে হচ্ছে বেশিরভাগ কাজ। সেতুর জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় দুই হাজার ৭০০ হেক্টর জমি। ক্ষতিগ্রস্ত ১৫ হাজার ৪০০ পরিবারের মধ্যে প্রায় তিন হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এক হাজার ৪৫৫ পরিবারকে পুনর্বাসন এলাকায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প এলাকায় এরই মধ্যে প্রায় এক লাখ ৭৩ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে বিশ্বে আমাজনের পরই পদ্মার স্থান। নকশা প্রণয়নে নদীর পানিপ্রবাহ, তলদেশ আগামী ১০০ বছর পর কেমন থাকবে, ভূমিকম্প প্রতিরোধে কী করা হবে— সেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চ্যালেঞ্জ অতিক্রমে ৩৮৩ ফুট গভীরে গিয়ে পাইলিং করা হয়েছে। দোতলাবিশিষ্ট সেতুটির অবকাঠামো। নিচে ডুয়েলগেজ রেলপথ এবং উপরে থাকছে ৭২ ফুট প্রশস্ত সড়কপথ। 

সেতু দিয়ে গ্যাসলাইন ও অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ নেওয়া হয়েছে। এর পাশ দিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে উচ্চমাত্রার বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন। ইস্পাতের কাঠামোর সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকছে আলোকব্যবস্থা। 

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাজিরা ও মাওয়া প্রান্তে প্রকল্পের নদীশাসন কাজ এবং মূল সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।

এমআই/এমএআর/এফআর