সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মাত্র ২ হাজার ৩১১ জন করদাতা ঘোষণা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ করেছেন। টাকার অংকে যার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর অর্জিত হয়েছে ১১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি।

গত ১৬ অর্থবছর ধরে বিরতিহীনভাবে এমন সুযোগ দেওয়া হলেও বাস্তবে বড় ধরনের সাফল্য মেলেনি। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা করার যে উদ্দেশ নিয়ে সুবিধা দেওয়া হয়, বাস্তবে তার সুফল মেলেনি। যদিও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওই বিশেষ সুযোগ নেই, তবে পাচার করা অর্থ ফেরতে আবার বিশেষ সুযোগ রাখা হয়েছে।

গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজারে ২৮৬ জনের প্রায় ৪০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগে আশার আলো দেখা গেলেও সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে এই খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাত্র ৫১ জন করদাতা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছেন গেল অর্থবছরে।

বিগত দিনের পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে দেখা যায়, মানুষ বিশেষ কোনো খাতের চেয়ে সরাসরি সুযোগ নিয়ে টাকা বৈধ করতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(এএএএএ) ধারায় অপ্রদর্শিত অর্থ সরাসরি ঘোষণা নিয়ে বৈধ করেছেন ২ হাজার ২৫১ জন করদাতা। যার পরিমাণ হলো ১ হাজার ১২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের বেশি করদাতা সরাসরি কর দিয়ে বৈধ করেছেন।

এর আগের অর্থবছরেও (২০২০-২০২১) সর্বাধিক ২০ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা সরাসরি বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করেছিলেন করদাতারা। ওই অর্থবছরেও ৯৮ শতাংশ করদাতা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণার মাধ্যমে সাদা বা বৈধ করার সুযোগ নিয়েছেন। কালো টাকা সাদা করার তালিকায় আছেন ডাক্তার, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, ব্যাংকের পরিচালক, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে।

আরও পড়ুন: কালো টাকা সাদা করার উদ্যোগ মানুষ গ্রহণ করবে : অর্থমন্ত্রী

এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণির করদাতারা ভিন্ন ভিন্ন সম্পদের বৈধতা নিয়েছেন। অনেক করদাতা আবার তাদের আয়কর রিটার্নে এসব সম্পদের ঘোষণা দিয়েছেন। আয়কর অধ্যাদেশের আওতায় সুযোগ গ্রহণকারী ব্যক্তিরা আসলে পুঁজিবাজারের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। আসলে তাদের কাছে পুঁজিবাজার এখনও আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি। তাই সুযোগ যতটুকু নিয়েছেন সরাসরি কর দেওয়ার মাধ্যমে নিয়েছেন। যদিও এ বছরে সেই সুযোগও বন্ধ রয়েছে।

অন্যদিকে এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুযোগটা হয়ত ভালো ছিল। কিন্তু কালো টাকা যাদের রয়েছে তাদের আসলে পুঁজিবাজার নিয়ে আগ্রহ নেই। তারা পুঁজিবাজার বুঝেও না। মূলত কালো টাকা মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনা যায়নি। তাই বাধ্য হয়ে সুযোগ গ্রহণ করবে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যায়নি। কালো টাকার মালিকরা নির্দ্বিধায় বিভিন্ন সেক্টরে বিনিয়োগ করছে ও পাচার করছে।

তিনি আরও বলেন, কালো টাকার উৎস বন্ধ করায় নজর দেওয়া উচিত। আমি মনে করি, ঋণ খেলাপিও কালো টাকার মালিক। এছাড়া আছেন অবৈধ পণ্যের (মাদক) ব্যবসায়ী, জমি ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি। এসব উৎস বন্ধে নজর না দিলে কালো টাকার প্রবাহ বন্ধ হবে না। করহার কমিয়ে সৎ করাদাতাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

২০২১-২২ অর্থবছরে বৈধ করার পরিসংখ্যান

সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ১৬২ কোটি ৭০ লাখ অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ বা সাদা হয়েছে। যেখানে ২ হাজার ৩১১ জন করদাতা বিভিন্ন সেক্টরে ওই টাকা বৈধ করেছেন।

এনবিআর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুযোগ নেওয়া করদাতাদের মধ্যে মাত্র ৫১ জন করদাতা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে বৈধ করেছে। যেখানে টাকার পরিমাণ ৩৩ কোটি ১০ লাখ টাকা।

অন্যদিকে সরাসরি ১৯ (এএএএএএ) ধারায় অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করেছেন ২ হাজার ২৫১ জন করদাতা। যার পরিমাণ হলো ১ হাজার ১২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এছাড়া আবাসন খাতে মাত্র ৯ জন করদাতা বিনিয়োগ দেখিয়ে ৯০ লাখ টাকা সাদা করেছেন।

আরও পড়ুন: পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের পক্ষে প্রতিমন্ত্রী

কালো টাকা সাদা করার তালিকায় আছেন ডাক্তার, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, ব্যাংকের পরিচালক, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে। শেয়ারবাজার কিংবা আবাসন খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে সরাসরি সুযোগ নিয়েছেন তারা। কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণকারীদের মধ্যে ৯৭ শতাংশের বেশি করদাতা সরাসরি কর দিয়ে বৈধ করেছেন। তারা ব্যাংকে রাখা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণার মাধ্যমে সুযোগ গ্রহণ করেছেন। যা সাদা বা বৈধ করা টাকার মোট পরিমাণের প্রায় ৬৮ শতাংশ।

গত বছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে সরাসরি কোনো বক্তব্য না থাকলেও পরে বিশেষ আদেশে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ঘোষিত সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়। ওই ঘোষণায় বলা হয়েছিল, প্রচলিত আইনে যাই থাকুক না কেন, ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের চলতি অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা যেকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে কর্তৃপক্ষসহ কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। একই সময় ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করলে ওই বিনিয়োগের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে আয়করসহ কোনো কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করবে না।

বিগত দিনের পরিসংখ্যান

গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ২০ হাজার ৬৫০ কোটি অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ বা সাদা হয়। যেখানে ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালো টাকা বৈধ করেছেন। যা দেশে স্বাধীনতার পর থেকে এক বছরের হিসাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ। যাদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি ব্যাংকে রাখা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন।

এনবিআর সূত্র বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন মধ্যে শেয়ারবাজার, নগদ টাকা কিংবা জমি-ফ্ল্যাট কিনে সবমিলিয়ে ১১ হাজার ৮৫৯ জন কালো টাকা সাদা করেছেন। এর মধ্যে শুধু জুন মাসেই এক হাজার ৪৫৫ জন ব্যক্তি সাদা করেছেন ৬১৯ কোটি টাকা।

কালো টাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ৭ হাজার ৫৫ জন ব্যক্তি ব্যাংকে রাখা বিভিন্ন আমানত, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র বা নগদ টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বৈধ করেছেন। তারা সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আইনগতভাবে বৈধ করেছেন।

এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় সব সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের পর বেশি অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগে এসেছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। তখন দেশের পরিস্থিতি ছিল একেবারেই ভিন্ন। ওই দুই বছরে ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল; বৈধ হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তা থেকে সরকার কর পেয়েছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে ২০০৭ সালে ৮০৩ কোটি টাকা এবং পরের বছর ৪০০ কোটি টাকা কর পেয়েছিল এনবিআর।

আরএম/এসএসএইচ