আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কোনো উন্নতি নেই
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, কারওয়ান বাজার শাখা
অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে সংকটে পড়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। নানা অব্যবস্থাপনায় বিতরণ করা ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না। খেলাপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাংকটি। নতুন করে করোনা মহামারিকে পুঁজি করে আরও খারাপের পথে ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা।
শুরুটা ‘আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ দিয়ে। এরপর ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’, এখন তা ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ নামে পরিচিত। জানা গেছে, সুদমুক্ত শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৭ সালের ২০ মে ‘আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে কার্যক্রম শুরু। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে নাম দেওয়া হয় ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’। মালিকানা হস্তান্তরের পর ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ব্যাংকটিতে। ভুয়া নথি আর মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৎকালীন উদ্যোক্তারা হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। চলে নজিরবিহীন লুটপাট। ফলে ব্যাংকটির পরিচালনাপর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। শৃঙ্খলা ফেরাতে সেখানে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন করে পুনর্গঠন করতে হয় ব্যাংকটি। বিক্রি করা হয় বিদেশি একটি গ্রুপের কাছে।
বিজ্ঞাপন
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আমানত এক হাজার ৫৬ কোটি টাকা। বিপরীতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৮৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকরণ বা খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৭১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। মোট খেলাপির মধ্যে আদায় অযোগ্য ‘মন্দ’ ঋণের পরিমাণ ৬৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা অর্থাৎ ৭৭ দশমিক ১৪ শতাংশ
২০০৮ সালে ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক’ নাম পরিবর্তন করে ‘আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড’ রাখা হয়। কিন্তু তারপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকটি। আর্থিক অবস্থারও উন্নতি হয়নি। খেলাপিতে জর্জরিত ব্যাংকটি সময়মতো অনেক গ্রাহকের আমানতের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না।
বিজ্ঞাপন
যারা খেলাপি গ্রাহক, ঋণ আদায়ে তাদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ করছি। কিছু আদায়ও হয়েছে। তবে মহামারি করোনার কারণে আদায় কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে
মো. আবুল হোসেন, এমডি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের আমানত এক হাজার ৫৬ কোটি টাকা। বিপরীতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৮৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকরণ বা খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৭১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। মোট খেলাপির মধ্যে আদায় অযোগ্য ‘মন্দ’ ঋণের পরিমাণ ৬৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা অর্থাৎ ৭৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ আদায়সহ ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যারা খেলাপি গ্রাহক, ঋণ আদায়ে তাদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ করছি। কিছু আদায়ও হয়েছে। তবে মহামারি করোনার কারণে আদায় কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।’
খেলাপি ঋণ কমাতে না পারায় ব্যাংকটি উন্নতি করতে পারছে না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত তাদের মনিটরিংয়ে রাখা। পরিচালনাপর্ষদকে ডেকে তাদের কাছে জানতে চাওয়া, তারা কী করছে
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই গ্রাহক ঋণ পরিশোধে নানা অজুহাত খোঁজে। কোভিডে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে এ সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। আমরা ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। গ্রাহকও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আশা করছি আগামীতে উন্নতি হবে।’
দীর্ঘদিন ধরে দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতে না পারায় ব্যাংকটি উন্নতি করতে পারছে না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত তাদের মনিটরিংয়ে রাখা। পরিচালনাপর্ষদকে ডেকে তাদের কাছে জানতে চাওয়া, তারা কী করছে? ঋণ আদায়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা, তার একটি কর্মপরিকল্পনা নেওয়া। তারা আসলে ঠিকমতো কাজ করছে কিনা, তা তদারকি করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া।’
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটি দুর্বল অবস্থায় পড়ে আছে। আরও কয়েকটি ব্যাংক আছে যাদের অবস্থাও খারাপ। আমি বলব, এসব ব্যাংককে ওয়ান-টু-ওয়ান ডেকে কাউন্সিলিং করা। ঋণ আদায়ে টার্গেট বেধে দেওয়া, পাশাপাশি কাজ ঠিকমতো করছে কিনা, সে বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা।
গতানুগতিক নির্দেশনা দিলে তাদের কোনো উন্নতি হবে না— মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।
এদিকে, ধারাবাহিক লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। ২০১৯ সালেও কোম্পানিটি ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করে। পুঁজিবাজারে দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি হিসেবে ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত হয়ে ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির শেয়ার অভিহিত মূল্যের (ফেসভ্যালু) নিচে লেনদেন হচ্ছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯০ পয়সায়। ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের মধ্যে ব্যাংকটির শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৫ টাকা ২০ পয়সায় যা ফেসভ্যালুর (১০ টাকা) প্রায় অর্ধেক।
ব্যাংকটি ২০১৯ সালের সংক্ষিপ্ত যে আর্থিক তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে বছর শেষে এর শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ৬৪ পয়সা ঋণাত্মক দেখানো হয়েছে। ২০১৯ সাল শেষে ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ৪৮ কোটি টাকা।
এসআই/এমএআর/