বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতা জানান দেয় পদ্মাসেতু, ছবি: অরিত্র অংকন মিত্র

১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর একাধিক গণতান্ত্রিক সরকার ও স্বৈরশাসক দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আসলেও আর্থিক খাতে পরিবর্তন হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিজয়ের ৫০ বছরে অর্থ ও বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক মুক্তি, রিজার্ভ, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ে উন্নত দেশগুলোকেও টেক্কা দিচ্ছে বাংলাদেশ।

হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘বটমলেস বাসকেট’-এর দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৪ বিলিয়ন ডলার (৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার) ছাড়িয়েছে। ১৯৭১ সালে ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ে শুরু করা বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের আগে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত ৮০ শতাংশ মানুষ, আজ সেই সংখ্যা ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রথম অর্থবছর (১৯৭২-৭৩) দেশের বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। ৫০ বছরের মাথায় এসে বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।

গ্রামাঞ্চলে এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। বার্ষিক মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বশেষ পরিমাণ ২৪ হাজার মেগাওয়াট। খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪৫১ লাখ টন। স্বাধীনতার আগে এর পরিমাণ ছিল অনেক নিচে। অন্যদিকে স্বাধীনতা পরবর্তী ৩৪৮ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় বেড়ে চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৮৬ কোটি ডলার।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি, তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স খাত। এতে ভর করেই বেড়েছে জিডিপি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ দিন ছিল ৩ থেকে ৫ শতাংশের ঘরে। তবে গত কয়েক বছর ধরেই তা ৮ শতাংশের ওপরে। করোনা মহামারির কারণে এবার সেটা কিছুটা কমলেও উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নয়। শিক্ষা, গড় আয়ু, আমদানি, রফতানি, রিজার্ভ, ডলারের মান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং মাথাপিছু আয়ের মতো প্রতিটি সূচকে এখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে। অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন ভারত থেকে এগিয়ে। বিস্ময়কর উত্থানের কারণ খুঁজছে ভারতও। স্বাধীনতার পরপর আমাদের ১০০ টাকা দিয়ে ভারতীয় ৩৫-৪০ রুপি পাওয়া যেত। আর এখন পাওয়া যায় ৮৫-৯০ টাকা। এদিক থেকে পাকিস্তানের অবস্থা আরও খারাপ, তারা ১৫৬ রুপি দিয়ে কেনে এক ডলার।

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভিশন ছিল একটা সমৃদ্ধ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ গঠন করা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মূল অভিযোগ ছিল অর্থনৈতিক। দেশ একটা হলেও অর্থনীতি ছিল দুটি। তখন পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিতদের সম্পদ ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা সম্পদশালী হয়েছিল। ওই সময় পাকিস্তানের কোনো সম্পদেরই ভাগ পূর্ব পাকিস্তান পাচ্ছিল না। এজন্যই একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য স্থির করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, যেখানে সবার জন্য স্যোশাল জাস্টিস থাকবে, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে সবাই ন্যায়বিচার পাবে, সেই ধরনের একটা সমাজ গড়ে তোলাই ছিল তার স্বপ্ন।’

ড. জাহিদ বলেন, ‘বর্তমানে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও এখনও সবাই একরকম বিচার পাচ্ছে না। সমাজের কাছেও পাচ্ছে না আবার আইনের কাছেও পাচ্ছে না। আইন তো কাগজে কলমে সবাইকে এক চোখে দেখে। কিন্তু বাস্তবে একজন গরিব লোকের আদালতে গিয়ে সুবিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই ওইরকম একটা সুষম সমাজ গড়ে তোলাই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। যেটা তাকে এতো কষ্ট করতে অনুপ্রাণিত করেছে।’

এই পর্যায়ে এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও সুষম সমাজ গড়ে উঠেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয়, বর্তমানে এখানেই সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে। দেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা অনেক কমছে, এটা ঠিক। কিন্তু পুরো সমাজের ক্ষেত্রে ‘জাস্টিস ফর অল’ নিশ্চিত হয়নি।

এসআর/এসকেডি/এমএমজে/আরএইচ