বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুত ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে

দীর্ঘ সংগ্রাম আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তখন ছিল শূন্য রিজার্ভ। এখন তা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা মজুত ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে।

সোমবার (৩ মে) দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার। যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৩ মে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন অর্থাৎ চার হাজার ৫১০ কোটি ডলার ছাড়ি‌য়ে‌ছে। বাংলা‌দে‌শি মুদ্রায় যার প‌রিমাণ তিন লাখ ৮৩ হাজার কো‌টি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসাবে মজুত এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে প্রায় ১১ মাসের বে‌শি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।

৩ মে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন অর্থাৎ চার হাজার ৫১০ কোটি ডলার ছাড়ি‌য়ে‌ছে। বাংলা‌দে‌শি মুদ্রায় যার প‌রিমাণ তিন লাখ ৮৩ হাজার কো‌টি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। প্রতি মাসে চার বিলিয়ন ডলার হিসাবে মজুত এ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে প্রায় ১১ মাসের বে‌শি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব

এর আগে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়া‌রি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ০২ বিলিয়ন অর্থাৎ চার হাজার ৪০২ কোটি ডলার ছাড়ায়। এরও আগে ৩০ ডি‌সেম্বর ৪৩ বিলিয়ন ডলার, ১৫ ডি‌সেম্বর ৪২ বি‌লিয়ন এবং গত বছরের ২৮ অক্টোবর রিজার্ভের পরিমাণ ৪১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রথম ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ২০২০ সালের অক্টোবরে। এরপর ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে এর পরিমাণ।

এদিকে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত যখন ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে তখন পাকিস্তানের মজুত ২৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন প্রায় দ্বিগুণ। অথচ এক সময় স্বাধীনতার বিরোধিতা করা সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। তার সেই ধারণা আজ ভুল প্রমাণিত। শুধু রিজার্ভ নয়, অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকে পাকিস্তান থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম বার্ষিক রিপোর্ট ১৯৭১-১৯৭৩ এর অষ্টম পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ছিল না। আস্তে আস্তে সেটি সঞ্চয় হতে থাকে। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ছিল ১১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ১৯৭৩ সালের ২৯ জুনে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকায়।'

৪০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮১-৮২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। যা এক মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়েও কম ছিল।

চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৬৭ কোটি (২০ বিলিয়ন) ডলার

১৯৯১-৯২ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১০০ কোটি (এক বিলিয়ন) ডলার অতিক্রম করে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে তা দুই বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর তা বেড়ে তিন বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ কমে ২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা ১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষের দিকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করে। রিজার্ভ ১০০ কোটি ডলারের নিচে নামলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে— এমন শঙ্কায় ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাকি রাখতে বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ইরান ও মালদ্বীপ— এ নয়টি দেশ বর্তমানে আকু’র সদস্য। এ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকু’র মাধ্যমে পরিশোধ ক‌রতে হয়। আকু’র বিল প‌রি‌শোধ কর‌লে রিজার্ভ কিছুটা ক‌মে যা‌য়।

চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৬৭ কোটি (২০ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ৭৫ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একের পর এক রিজার্ভের মাইলফলক অতিক্রমের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। মাঝেমধ্যে হোঁচট খেতে হয়েছে। আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে। বিদেশি মুদ্রার মজুত বর্তমানে যে অবস্থায় আছে এটাকে খুবই ‘আশাব্যঞ্জক’ উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা পোস্ট‌কে ব‌লেন, ‘এক দিনেই রিজার্ভ এ অবস্থানে আসেনি। স্বাধীনতার পর ৮৮ সাল পর্যন্ত রিজার্ভ এক বিলিয়ন ডলারের নিচে ছিল। বর্তমানে ৪৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি এবং আমদানি ব্যয় কম হওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে প্রায় ১১ মাসের বেশি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে। যা স্থিতিশীল অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ঈদকে সামনে রেখে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। সদ্যসমাপ্ত এপ্রিল মাসে প্রবাসীরা ২০৬ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার (২.০৬ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।

রেমিট্যান্সের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৬৭ কোটি (২০ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ এক লাখ ৭৫ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি।

এদিকে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ৩১৩ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের (এপ্রিল) চেয়ে ৫০২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া, সার্বিকভাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) তিন হাজার ২০৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আট দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

এসআই/এমএআর/