বিনিয়োগে নানা শর্ত ও মহামারি করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে কমতে শুরু করেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পাঁচ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। 

এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ কম। গত বছর জুলাই মাসে আট হাজার ৭০৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের এ তথ্য জানা গেছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিমাত্রায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে নানা শর্ত জু‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে সরকার। এছাড়া করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে বিশেষ বিধিনিষেধের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিনিয়োগকারীরা সহজে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেননি। ফলে কমেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে মোট পাঁচ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে পরিশোধ হয়েছে তিন হাজার ২৬১ কোটি টাকা। মূল অর্থ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থ নিট বিক্রি হিসেবে গণ্য হয়। সেই হিসেবে আলোচিত সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ দুই হাজার ১০৪ কোটি টাকা। আগের বছরও এ সময় নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির জন্য প্রতিবছর বাজেটে সরকার লক্ষ্য ঠিক করে দেয়। কিন্তু বেশি মুনাফা ও নিরাপদ বিনিয়োগ হওয়ায় প্রতিবারই দেখা যায়, লক্ষ্যের চেয়ে বিক্রির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি হয়।

সবশেষ গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয় দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয় দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, যা গেল অর্থবছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্য ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা।
 
সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে সরকার। সব শেষ বাজেটে দুই লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে কর সনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র মিলবে শুধু সঞ্চয় অধিদফতরের। 

চলতি বছরের ১৮ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে জানানো হয়, এখন থেকে তফসিলি ব্যাংকের শাখা বা ডাকঘর থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। শুধু জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের আওতাধীন সঞ্চয় ব্যুরো থেকে এ সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে। এখন যদি কোনো বিনিয়োগকারী পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র কিনতে চান, তাহলে শুধু সঞ্চয় অধিদফতরের শাখা অফিসগুলোতে গিয়ে কিনতে পারবেন।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এক লাখ ১২ হাজার ১৮৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭০ হাজার ২২৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গেল অর্থবছরের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ আসে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।

আগের অর্থবছরগুলোর হিসাব দেখলে দেখা যায়, এর আগে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। সে বছর ৯০ হাজার ৩৪২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিক্রি হয়েছিল ৬৭ হাজার ১২৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ১৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। বিক্রির অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এর বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দেয় সরকার। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ করে কমানো হয়েছিল। ওই সুদহারই এখন পর্যন্ত বহাল আছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর গত ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমি‌য়ে‌ছে সরকার। এখন সঞ্চয়পত্রে যাদের ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ আছে, তাদের মুনাফার হার দুই শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকার নিচে মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আগের নিয়মেই তারা মুনাফা পাবেন।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মে’র পর থেকে এ হার কার্যকর রয়েছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। তবে নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এখন যারা ১৫ লাখের বেশি টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন, তাদের দুই শতাংশ কম মুনাফা দেওয়া হবে।  

এসআই/আরএইচ