•  সম্পদ রক্ষায় হাওরের উন্নয়ন জরুরি : পরিকল্পনামন্ত্রী
•  হাওর উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান : মন্ত্রণালয়
•  পিসিআরের তথ্যের সঙ্গে কাজের মিল নেই : আইএমইডি
•  প্রকল্প পরিদর্শনে আইএমইডি’র সাত সুপারিশ

সুনামগঞ্জ জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের অন্যতম একটি নিদর্শন হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। জেলা ব্র্যান্ডিং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের পর টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। কর্মপরিকল্পনার আলোকে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, অতিথি পাখি রক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে হাওরে মাছের উৎপাদন ও অতিথি পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, হাওর ঘিরে সরকারের মহাপরিকল্পনায় ‘টাঙ্গুয়ার হাওর তৃতীয় পর্যায়’ শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। বাস্তবায়িত কার্যক্রম টেকসই করতে এবং এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় ‘কমিউনিটি বেজড সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট অব টাঙ্গুয়ার হাওর প্রজেক্ট (ব্রিজিং পর্যায়)’ প্রকল্পটি হাতে নেয় মন্ত্রণালয়।

ব্রিজিং প্রকল্পটি গ্রহণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হাওর ঘিরে মেগা প্রকল্প গ্রহণ। কিন্তু ব্রিজিং প্রকল্পটি শেষ হলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বর্তমানে হাওরের টেকসই উন্নয়নের কাজটি থমকে গেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এমন কাজের ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। আইএমইডি গত বছরের আগস্টে প্রকল্পটি পরিদর্শন করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে টাঙ্গুয়ার হাওরে ১৪০টির বেশি প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া করচ, নল খাগড়া, বনতুলিসহ বিলুপ্তপ্রায় বহু প্রজাতির গাছ-গাছালি হাওর এলাকায় রয়েছে। এ হাওরের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে। এর বাইরেও প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাসস্থল এ হাওরে। প্রতি বছর শুধু শীতকালে পৃথিবীর বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে আরও প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এ হাওরকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়। ফলে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আহমদ শামীম আল রাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান আছে। হাওরের সম্পদ রক্ষায় মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। 

মেগা প্রকল্পটি নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও নেয়া হয়নি, এটা সত্য। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আছে, হাওরের সম্পদ রক্ষায় একটি বড় প্রকল্প গ্রহণের। এর বাইরে কাগজপত্র না দেখে আমি আর কিছু বলতে পারব না

আহমদ শামীম আল রাজী, উন্নয়ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব

আইএমইডি’র রিপোর্টে বলা হয়েছে, টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্থায়িত্বশিলতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সমাজভিত্তিক সহ-ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় সংগঠিত জনগণকে স্বাবলম্বী করার জন্য সমর্থন প্রদান করাই মূল উদ্দেশ্য। শেষ হওয়া তৃতীয় পর্যায়ে গঠিত ৪১টি সমাজভিত্তিক সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির মধ্যে চারটি কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পর সমন্বয় ও পারস্পরিক আস্থার অভাবে সমিতির সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ব্রিজিং প্রকল্পের আওতায় তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪০টি গ্রামে নতুনভাবে সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, পিসিআর এ অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ তথ্য দেখা গেছে। পিসিআর’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় তিন কোটি ৪৭ লাখ টাকার বিপরীতে আরএডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তিন কোটি দুই লাখ টাকা, যা প্রকল্প ব্যয়ের ৮৭.০১ শতাংশ। বরাদ্দের ৮৭.০১ শতাংশ অর্থের বিপরীতে ৮০ শতাংশ বাস্তব কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭২.৭৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয় এবং ৯৭.৫ শতাংশ বাস্তব অগ্রগতি দেখানো হয়েছে পিসিআরে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ বাস্তব কাজের পরিকল্পনার বিপরীতে ৯৭.৫ শতাংশ অগ্রগতির তথ্য দেখানো হয়েছে। এছাড়া পিসিআরে প্রদত্ত আরএডিপি বরাদ্দ ও বাস্তব কাজের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আর্থিক অগ্রগতি দেখানো হলেও বাস্তব অগ্রগতি দেখানো হয়নি। 

বাস্তব কাজের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ শতাংশের বিপরীতে অঙ্গভিত্তিক অগ্রগতির তথ্যে বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯৭.৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে। যা অসামঞ্জস্য ও ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে

ব্রিজিং প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় মূলত তৃতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষাসহ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বৃহদাকারের একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য। যা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর আজন্ম যেভাবে চলে এসেছে, সেভাবে চলার স্বাধীনতা দিতে হবে। না হলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।

হাওরের টেকসই উন্নয়ন হওয়া জরুরি। তবে সেখানে বাঁধ দিয়ে ঘরবাড়ি বানালে হবে না। পর্যটকদের জন্য পর্যটনকেন্দ্র করা যাবে না। পরিকল্পিতভাবে ইকো ট্যুরিজম করতে হবে

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ হাওর উন্নয়ন করতে হলে অনেকগুলো মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ এখানে পরিবেশের কাজ আছে, পানি সম্পদের কাজ আছে, এলজিইডির কাজ আছে। এর বাইরেও আরও যেসব মন্ত্রণালয় জড়িত তাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আইএমইডি’র প্রতিবেদনের সুপারিশ
 ১. উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থব্যয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকল্পের অনুকূলে আরএডিপিতে বরাদ্দ অর্থের ৮৭.০১ শতাংশের বিপরীতে ৮০ শতাংশ বাস্তব কাজের লক্ষ্যমাত্রা ৭.০১ শতাংশ কম গ্রহণ করা হয়। সংস্থান করা আর্থিক লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পের ভৌত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। 

ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রয়োজন থাকলেও সংশোধনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করার বিষয়টি পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে

২. প্রকল্পের অর্থব্যয় সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য পিসিআর এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে অসামঞ্জস্যতার কারণে প্রকৃত ব্যয় নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। অসামঞ্জস্য তথ্য/প্রকৃত ব্যয় কম/বেশি করা হয়ে থাকলে তার কারণ ও আর্থিক ব্যয়ের বিষয় মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখতে পারে এবং এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডিকে জানাতে হবে।

৩. প্রকল্পটির অনুমোদিত অঙ্গসমূহের বিপরীতে কোন অঙ্গে কী পরিমাণ বাস্তব কাজ ও অর্থব্যয় হয়েছে, তা পিসিআরে যথাযথভাবে প্রতিফলন না করায় প্রকৃত অগ্রগতি এবং পরিকল্পিত উদ্দেশ্য অর্জনের হার নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি বিধায় প্রকল্পের এ সংক্রান্ত তথ্যাদি পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে প্রেরণ করতে হবে।

৪. প্রকল্পের মেয়াদকালে বছরওয়ারি অব্যয়িত অর্থ (সর্বমোট ৮২.৬৬ লাখ টাকা) যথানিয়মে সরকারি কোষাগারে জমাদান সংক্রান্ত বার্ষিক রিকনসিলিয়েশন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করবে এবং আইএমইডিকে তা অবহিত করবে।

৫. তৃতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের বাস্তবায়িত কার্যক্রম টেকসইকরণ ও ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে ব্রিজিং প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ব্রিজিং প্রকল্পের অনুমোদিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় স্থায়ীত্বশিলতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বৃহদাকারের একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সমীচীন হতো। যথাসময়ে প্রকল্প গ্রহণ না করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।

৬. অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত বিএসআর আইএমইডি’তে প্রেরণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।

৭. ভবিষ্যতে সমাপ্ত প্রকল্পের পিসিআর প্রেরণকালে নির্ধারিত ছক অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল তথ্য প্রতিফলনের বিষয়টি নিশ্চিতের পাশাপাশি এ ধরনের তথ্য প্রেরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আরও যত্নবান হতে হবে।

উল্লেখ্য, টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলা ঘিরে প্রায় ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর আয়তনের হাওর। হাওরজুড়ে ছোট-বড় ১২০টি বিল রয়েছে। দুই উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে দুই লাখ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি।

২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি এ হাওরকে ‘রামসার সাইট’ বা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। হাওরের সম্পদ পাহারায় বর্তমানে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আনসার ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত নিরাপত্তাকর্মীরা কাজ করছেন।

এসআর/এমএআর/ওএফ