ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করছেন না গ্রাহক। আবার অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি এবং পর্ষদের স‌ঙ্গে আঁতাত ক‌রে নেওয়া ঋণ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। সঙ্গে নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় ব্যাংকের টাকা নিজের মনে করে রেখে দিচ্ছেন অসাধুরা। এমন পরিস্থিতিতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে মন্দ বা খেলাপি ঋণ। আদায়ে কঠোর না হওয়ায় নীতি-সহায়তার সুযোগে ঋণ নিয়মিত দেখানোর পথ পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা। অন্যদিকে, কাগজে-কলমে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে পুনঃতফসিলের পথ বেছে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতে ১৮ হাজার ৮১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) পুনঃতফসিল করা হয়েছে তিন হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ১০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা এবং তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চার হাজার ৫৫৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করা হয়েছে।

এর আগে ২০২২ সালে (১২ মাস) ব্যাংক খাতে ২৯ হাজার ২৭৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা এবং ২০২১ সালে ১২ হাজার ৩৭৯ কোটি ২৬ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম, দুর্নী‌তি, রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিচালনা পর্ষদের স‌ঙ্গে আঁতাত করে নেওয়া ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না গ্রাহকরা। আবার অনেকে ছাড়ের আশায় ইচ্ছা করে ঋণ শোধ করছেন না। এমন পরিস্থিতিতে আদায়ে কঠোর না হয়ে নীতি-সহায়তা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এ সুযোগে ঋণ নিয়মিত দেখানোর পথ পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা।

কখনও বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিল, কখনও পুনর্গঠনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের আসল তথ্য থেকে যাচ্ছে আড়ালে। এসব কারণে খেলাপির স‌ঙ্গে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বাড়ছে। সুবিধা পাওয়া এসব ঋণের অর্থ ব্যাংকগুলো আগামীতে ফেরত পাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

ব্যাংকাররা জানান, আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষমতা ছিল। তখন ব্যাংকগুলো তাদের পর্ষদে পুনঃতফসিলের প্রস্তাব পাস করে তা অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাত। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিত পুনঃতফসিল করা হবে কি না। ২০২২ সালের জুলাই মাসে পুনঃতফসিলের ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছা মতো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করছে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর যখন দেখে ঋণ ফেরত পাব না, তখন পুনঃতফসিল করতে বেশি আগ্রহ দেখায়। কারণ, পুনঃতফসিল করতে পরলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। তার আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে পারছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এতে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

কাগজে-কলমে আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাচ্ছে অনেক ব্যাংক— এমন অভিযোগ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বেশির ভাগ ব্যাংক তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যে তথ্য আর্থিক প্রতিবেদনে দেখাচ্ছে তা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে অনেক ব্যাংকের শুধু কাগজে-কলমে আর্থিক অবস্থা ভালো। কিন্তু বাস্তবচিত্র খুবই খারাপ।’

অনিয়ম, দুর্নী‌তি, রাজনৈতিক প্রভাব ও পরিচালনা পর্ষদের স‌ঙ্গে আঁতাত করে নেওয়া ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না গ্রাহকরা। আবার অনেকে ছাড়ের আশায় ইচ্ছা করে ঋণ শোধ করছেন না। এমন পরিস্থিতিতে আদায়ে কঠোর না হয়ে নীতি-সহায়তা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এ সুযোগে ঋণ নিয়মিত দেখানোর পথ পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা। কখনও বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিল, কখনও পুনর্গঠনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের আসল তথ্য থেকে যাচ্ছে আড়ালে। এসব কারণে খেলাপির সঙ্গে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ বাড়ছে। সুবিধা পাওয়া এসব ঋণের অর্থ ব্যাংকগুলো আগামীতে ফেরত পাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা

কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিষয়গুলো এখন স্বীকার করছে। ফলে এসব ক্ষত সারাতে রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। ওই ঘোষণা কাগজে-কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সংস্কারকাজ যেন জোরালো করা হয়— এমন প্রত্যাশা অর্থনীতিবিদদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী অনেক আগে থেকেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। একসময় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করা যেত। এখন ৩ শতাংশ নিয়ে পুনঃতফসিল করতে পারে ব্যাংক। এ ছাড়া, এখন ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রথমে দুই দফায় আট বছর করে ১৬ বছর, তৃতীয় দফায় সাত বছর এবং চতুর্থ দফায় ছয় বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে প্রকৃত ঋণ খেলাপির অঙ্ক আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের চিত্র

গেল বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এসআই/এসএসএইচ