শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারী

শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সোমবার (২৬ এপ্রিল) বিকেল তিনটায় জরুরি বোর্ড সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ভার্চুয়াল বোর্ড সভায় সভাপতিত্ব করেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার। এ সময় অন্যান্য পরিচালকরাও যুক্ত ছিলেন। সভায় এমডি নিয়োগের নির্ধারিত এজেন্ডা অনুযায়ী আলোচনা শুরু হলে সবার সম্মতিতে বর্তমানে ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। পরে অনুমোদনের জন্য আজই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়।  

শাহ্ সৈয়দ আব্দুল বারী ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজকল্যাণ বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের মাধ্যমে তার ব্যাংকিং পেশা শুরু করেন। এরপর আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘ কর্মজীবনের ১২ বছর শাখা ব্যাংকিংয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হন।
 
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই ন্যাশনাল ব্যাংকে। বারবার বলার পরও টনক নড়ছে না ব্যাংকটির। এবার এমডি নিয়োগে চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে একজন স্থায়ী এমডি নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে। তা না হলে আইন অনুযায়ী প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে।

গত ১৯ এপ্রিল (সোমবার) বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদারকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ২৮ এপ্রিলের মধ্যে এমডি নিয়োগ না দিলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৫–ক ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি নিয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, আইন অনুযায়ী তাদের স্থায়ী এমডি নিয়োগ দিতে হবে। দীর্ঘদিন এ পদ খালি রাখা যাবে না। এ ধরনের একটি নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনেও এটি বলা আছে। আইন অনুযায়ী তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন যদি তারা পরিপালন করে তাহলে সমস্যা নেই। আর যদি না করে তাহলে আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৫–ক ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের এমডি পদ একাধারে তিন মাসের বেশি শূন্য রাখা যাবে না। ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে এমডি পদ পূরণ না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে, যিনি ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করবেন। আইন অনুযায়ী আগামী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে এমডি নিয়োগ না দিলে ব্যাংকটিতে প্রশাসক দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এদিকে ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) না থাকা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরিচালনা পর্ষদে শুরু হয়েছে বিবাদ। সব মিলে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে ন্যাশনাল ব্যাংকে। এর আগে ব্যাংকটির অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুল এমডির চলতি দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে সরিয়ে দিতে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

পরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার তার মেয়াদ বাড়ান, যা কার্যকর হয় ১ এপ্রিল থেকে। কিন্তু বিষয়টি বিধি পরিপন্থী হওয়ায় তাকে চলতি দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে আরেকবার (৬ এপ্রিল) নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশের পর এ এস এম বুলবুলকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ্‌ সৈয়দ আবদুল বারীকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেয় ব্যাংকটির পর্ষদ। ২৮ এপ্রিল ব্যাংকটির স্থায়ী এমডি পদ শূন্য থাকার তিন মাস পূর্ণ হবে।

ন্যাশনাল ব্যাংক চলছে অনেকটা সিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। দীর্ঘদিন এর চেয়ারম্যান ছিলেন জয়নুল হক সিকদার। গত ১০ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। এরপর কোনো পর্ষদ সভা হয়নি। কিন্তু ঋণ বিতরণ অব্যাহত রাখা হয়েছে, যেখানে বেশকিছু অনিয়মের ইঙ্গিত পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জয়নুল হক সিকদারের মৃত্যুর পর ব্যাংকটি নিজেদের একক নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছেন পরিচালক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। তারা দুজনই জয়নুল হক সিকদারের ছেলে। তবে মেয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) পারভীন হক সিকদারসহ অন্য পরিচালকরা চাচ্ছেন নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে। অনিয়ম করে ঋণ বিতরণসহ নানা কারণে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যাংকটির পরিচালকদের মধ্যে দুটি পক্ষ হওয়ায় পর্ষদে বিবাদ শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত এমডি এ এস এম বুলবুলের নিয়োগ নিয়েও দ্বিমত রয়েছে অনেক পরিচালকের।

ন্যাশনাল ব্যাংকের এসব ঘটনা নজরে এলে গত ৫ এপ্রিল বেশকিছু তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ঋণ বিতরণ না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া রংধনু বিল্ডার্স, দেশ টিভি, রূপায়ণ ও শান্তা এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে দেওয়া সব ঋণের দলিলাদি (ঋণ আবেদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত) এবং ঋণের পূর্ণাঙ্গ হিসাব বিবরণীর কপি পাঠাতে বলা হয়। যদিও বিতরণ করা অনেক ঋণের নথি দেখাতে পারছে না ন্যাশনাল ব্যাংক।

ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যাংকটি নতুন করে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ১১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ঋণের ওপর প্রথম প্রান্তিকে সুদ যুক্ত হয়েছে ৬৫০ কোটি টাকা। সব মিলে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। তবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে মাত্র ৫২১ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকটির ৪০টি শাখা লোকসানে রয়েছে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা, চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ৪২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। মার্চে বেড়ে হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার দীর্ঘ দিন ধরে ফেসভ্যালুর নিচে রয়েছে।

এসআই/আরএইচ