পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি রফতানি করেছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান শাখার গ্রাহক কক্সবাজারের ‘মেসার্স কুলিয়ারচর সিফুডস লিমিটেড’। রফতানি পণ্যের টাকা এখনও দেশে ফেরত আসেনি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ওই প্রতিষ্ঠানকে রফতানির বিপরীতে নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছে ব্যাংকটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিনিয়ত এভাবে পাচার হচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এ অর্থে বিদেশে গড়ে তোলা হচ্ছে বিত্তবৈভব, আয়েশি জীবনযাপন করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ কাতারে রয়েছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও। অভিযোগ আছে, এক শ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে নানা কৌশলে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন একটি ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। অর্থপাচারের এ ঘটনার সঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নাম জড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রফতানির নামে টাকা পাচার করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কক্সবাজারের গ্রাহক ‘মেসার্স কুলিয়ারচর সিফুডস লিমিটেড’। জালিয়াতির মাধ্যমে প্রথমে পাঁচ লাখ ৫৮ হাজার ৭২০ ডলার, পরবর্তীতে ৪৪ হাজার ছয় মার্কিন ডলারের দেশীয় সম্পদ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৮৮ টাকা ( প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রফতানির নামে টাকা পাচার করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কক্সবাজারের গ্রাহক ‘মেসার্স কুলিয়ারচর সিফুডস লিমিটেড’। জালিয়াতির মাধ্যমে প্রথমে পাঁচ লাখ ৫৮ হাজার ৭২০ ডলার, পরবর্তীতে ৪৪ হাজার ছয় মার্কিন ডলারের দেশীয় সম্পদ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ কোটি ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৮৮ টাকা ( প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। 

২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন অনিয়মের বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংককে সতর্ক করে। অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া সমুদয় অর্থ সমন্বয় করতেও বলা হয়। একই সঙ্গে গ্রাহকের নামে বরাদ্দ দেওয়া রফতানি সহায়তার ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তা না করে উল্টো ওই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ২৬ কোটি টাকার অধিক রফতানি সহায়তা দেয় মার্কেন্টাইল ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গ্রাহক মেসার্স কুলিয়ারচর সিফুডস লিমিটেড ২০১৬ সালের ১২ জুলাই চিংড়ি রফতানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। পাঁচ লাখ ৫৮ হাজার ৭২০ মার্কিন ডলার মূল্যের চিংড়ি ক্রয় করে কানাডার প্রতিষ্ঠান ইকোপ্যাক ইনস. কিউবেক। ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে একই মাসের (জুলাই) ২১ ও ২৭ তারিখে শিপমেন্ট সম্পন্ন হয়। এলসির করেসপন্ডেন্ট (প্রতিনিধিত্ব) ব্যাংক ছিল সোলেইল চার্টার্ড ব্যাঙ্ক, নিউ ইয়র্ক, ইউএস (Soleil Chartered Bank, New York, USA)। কিন্তু এ রফতানি মূল্যের অর্থ দেশে আসেনি। 

একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর দুই লাখ ৩৪ হাজার ডলার মূল্যের এক হাজার ৬০০ কার্টন চিংড়ি যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করে একই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এক হাজার কার্টন চিংড়ি প্রত্যাখ্যান করেন বিদেশি ক্রেতা। বাকি ৬০০ কার্টন চিংড়ির মূল্য ছিল এক লাখ সাত হাজার ২০০ ডলার। কিন্তু দেশে এসেছে এর অর্ধেক অর্থ। ওই ৬০০ কার্টন চিংড়ির বিপরীতে ৬২ হাজার ৯৯৩ মার্কিন ডলার দেশে ফেরত আসলেও ৪৪ হাজার ২০৬ ডলার এখনও আসেনি।

২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন অনিয়মের বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংককে সতর্ক করে। অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া সমুদয় অর্থ সমন্বয় করতেও বলা হয়। একই সঙ্গে গ্রাহকের নামে বরাদ্দ দেওয়া রফতানি সহায়তার ১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তা না করে উল্টো ওই প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ২৬ কোটি টাকার অধিক রফতানি সহায়তা দেয় মার্কেন্টাইল ব্যাংক।

এদিকে, অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে পূর্বের দায় সমন্বয়ের চেষ্টা করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। যা রফতানি নীতির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

উল্লেখ, সরকার ঘোষিত রফতানি প্রণোদনার আওতায় প্রকৃত রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে রফতানি মূল্য দেশে আসার পর নির্দিষ্ট হারে নগদ অর্থসহয়তা দেওয়া হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, রফতানি মূল্য বাকি থাকলে পরবর্তী দুই বছর তাকে আর নগদ অর্থসহায়তা দেওয়া যাবে না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষা করে ‘কুলিয়ারচর সিফুডস লিমিটেড’-কে নগদ অর্থসহায়তা দিয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহক ও ব্যাংকার উভয়ের যোগসাজশে টাকাগুলো পাচার হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আদালত থেকে স্টে অর্ডার (স্থগিতাদেশ) নেওয়া যায়। তবে তার মেয়াদ তিন থেকে সর্বোচ্চ ছয় মাস। মেয়াদ শেষে আদালতে শুনানির জন্য বিষয়টি তুলতে হয়। কিন্তু মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আর যোগাযোগই করা হয়নি। ফলে মামলাটি এখন ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে।

সূত্র জানায়, শুধু ওই ঘটনা নয়, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে সূক্ষ্মভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের বিদেশে অর্থপাচারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বিধান অনুসারে, বন্দর থেকে পণ্য রফতানির পরপরই তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশবোর্ডে রিপোর্ট করতে হয়। সেখানে রিপোর্টিংয়ের চার মাসের মধ্যে রফতানি মূল্য দেশে আনতে হয়। কিন্তু পণ্য রফতানির পর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাশবোর্ডে রিপোর্ট করা হয়নি। এভাবে রফতানির তথ্য দীর্ঘদিন গোপন করে মোটা অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারের সুযোগ করে দিয়েছে ব্যাংকটি।

অভিযোগ আছে, রফতানি মূল্য দেশে না এলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রণোদনা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও দায় এড়াতে পারে না— বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটরিং না থাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক জালিয়াতি করে গ্রাহকের প্রণোদনার অর্থ ছাড় করিয়ে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই ঘটনায় অর্থ ফেরত আনার জন্য একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি এখনও চলমান। বাংলাদেশ ব্যাংকও এ বিষয়ে অবগত আছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলসির মাধ্যমে পণ্য রফতানির সময় দুই দেশের ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি হয়। সেই হিসেবে রফতানির পর আমদানিকারকের পক্ষের ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করবে। পণ্য রফতানির পর মূল্য না আসলে সেটি পাচার বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কাস্টম কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে। 

‘পণ্যের আমদানি কিংবা রফতানির মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থপাচারের ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যাংকারদের যোগসাজশে অনিয়মগুলো হয়। এটি নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’

বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে যা আছে

পণ্য রফতানির পর তিন থেকে চার মাসের মধ্যে রফতানির বিল দেশে আনতে হয়। কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে অর্থ আনা সম্ভব না হলে তা উপযুক্ত কারণসহ ব্যাংককে জানাতে হবে। ব্যাংক এ বিল আনার জন্য সর্বোচ্চ ছয় মাস সময় বাড়াতে পারে। এ সময়ের মধ্যে রফতানি আয় ফিরিয়ে আনতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী, যে ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানি হয়েছে ওই ব্যাংক আমদানিকারকের ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করবে। কোনো ব্যাংক না আনলে সেগুলোকে পাচার বলে ধরে নেওয়া হয়। মূলত, দুই দেশের ব্যাংকের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে পণ্য রফতানি হয়। ফলে রফতানির অর্থও ব্যাংকের মাধ্যমে এ দেশে আসবে। রফতানিকারক বা অন্য কেউ ইচ্ছা করলেও ওই মূল্য বিদেশে রাখার সুযোগ নেই। কোনো কারণে সমস্যা হলে সেটাও ব্যাংকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে।

এসআই/এমএআর/