#দুরবস্থায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংক
#সবচেয়ে বেশি সংকট কৃষি ব্যাংকে

বিভিন্ন কেলেঙ্কারি ও অনিয়ম-জালিয়াতি আর নানা অব্যবস্থাপনায় দেওয়া ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ফলে মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে বড় আকারে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের আমানতের অর্থ থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়। সেই ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আবার খারাপ ঋণের ওপর অতিরিক্ত মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করতে না পারা ও লাগামহীন খেলাপি ঋণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বেশকিছু ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুন প্রান্তিক শেষে মোট ১১টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের পাঁচটি, বিশেষায়িত খাতের দুইটি ও বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতি ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমান নিয়মে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ ন্যূনতম মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এর বাইরে আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকগুলোকে ২০১৬ সাল থেকে অতিরিক্ত মূলধন রাখতে হচ্ছে।

যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়। চলতি বছরের ছয় মাসে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা বেড়ে ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এতে মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন শেষে মূলধন সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক। এছাড়া বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে ব্যাংকিং খাত ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখছে। এতে দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত যত দ্রুত সম্ভব এ সংকট উত্তরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

মূলধন ঘাটতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যতদিন স্থায়ী সমাধান না হবে, ততদিন এ অবস্থা চলতেই থাকতে। সরকারি সব ব্যাংকেরই একই অবস্থা। মূলধন ঘাটতি পূরণে আমরা সরকারের কাছে একটি স্থায়ী সমাধান চেয়েছি। এর মানে আমাদের অর্থ দিতে হবে তা নয়। সরকারি বন্ড দিয়েও এ ঘাটতি মেটানো যায়।

তিনি বলেন, আমরা যতটুকু সম্ভব ঘাটতি মেটাতে কাজ করছি। ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছি। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১০০ দিনের একটি প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছে। খেলাপি গ্রাহকদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান আলোচনা করে ঋণ আদায়ে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন সুবিধার পরও রাষ্ট্রীয় মালিকানার ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটি এখন মূলধন সংকটে আছে। জুন মাস শেষে এসব ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৫৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূলধন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৫৫৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এছাড়া অগ্রণীর এক হাজার ৯৬০ কোটি ২৩ লাখ টাকা, বেসিক ব্যাংকের এক হাজার ৯২৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা, রূপালীর ব্যাংকের ৬৬৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং জনতা ব্যাংকের ৩৪৫ কোটি টাকা।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ১১ হাজার ৮৪৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি এক হাজার ৫০৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৬৪২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ১১৪৬ কোটি ২১ লাখ টাকা, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স) ৪৬১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং এবি ব্যাংক ৩২৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী খেলাপির বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এ হার বেশি। এর মূল কারণ এসব ব্যাংকে সুশাসনের অভাব রয়েছে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।

এখন ঘাটতি কমাতে হলে ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে হবে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে, যাতে নতুন করে আর খেলাপি ঋণ না বাড়ে। তাহলেই অবস্থা উন্নতি হবে- বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।

জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি তৈরি হলে বাজেট থেকে যোগান দিতে হয়। জনগণের করের টাকায় বিভিন্ন সময় মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংকগুলোতে অর্থ যোগান দেয় সরকার। তবে করের টাকায় মূলধন যোগানের বরাবরই বিরোধিতা করে থাকেন অর্থনীতিবিদরা। এ কারণে গত কয়েক বছর ধরে এ অর্থ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।

এরপরও মূলধন ঘাটতি পূরণে ১০ হাজার কোটি টাকা সরকারের কাছে চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলধন ঘাটতি পূরণে বাজেট থেকে নগদ অর্থ না নিয়ে নগদ সহায়তার বিপরীতে সরকারের অনুকূলে শেয়ার ইস্যু বা সরকারি গ্যারান্টিপত্র অথবা নামমাত্র সুদে পারপেচুয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব দিয়েছে সোনালী ব্যাংক।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের যোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।

এসআই/এসএসএইচ