বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পর এবার ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি লিমিটেডের গ্রাহকের অর্থ লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

গ্রাহকদের দুই হাজার ১২৫ কোটি টাকা লোপাট করেছেন ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা। গত এক দশকে লোপাটের এ টাকা বিদেশেও পাচার করেছেন তারা। বিশেষ নিরীক্ষায় এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। নিরীক্ষাটি করেছে বিএসইসি।

লোপাট ও অর্থপাচারের মূলহোতারা হচ্ছেন— ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, পরিচালক এম এ খালেক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হেমায়েত উল্লাহ। তারা পরিকল্পিতভাবে গ্রাহকের টাকা লোপাট ও পাচার করেছে। তাদের সঙ্গে আরও কিছু লোক জড়িত রয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন মতে, ২ হাজার ১২৫ কোটি টাকার মধ্যে ৮৫৪ কোটি টাকা অবৈধভাবে জায়গা অধিগ্রহণের মাধ্যমে, তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৬৫৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং কোম্পানিগুলোর মুদারাবা মেয়াদি আমানতের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ৪২১ কোটি টাকা লোপাট করেছে। এছাড়া দুটি ভুয়া সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ১৯২ কোটি টাকা লোপাট করেছে মালিকরা।

লোপাটের মূলহোতাদের মধ্যে অন্যতম ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। তিনি বিভিন্নভাবে গ্রাহকের টাকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বাড়ি-গাড়ি এবং নামে-বেনামে কোম্পানিও গড়ে তোলেন।

এ অর্থ লোপাট ও পাচারের প্রমাণ অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সিআইডিকে দিয়েছে বিএসইসি।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এমএ খালেকের পর কৌশল ও প্রভাব খাটিয়ে নজরুল ইসলাম ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময়ে মেয়াদে লোপাট এবং অর্থপাচারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন সাবেক পর্ষদ কোম্পানির নামে ১২টি জায়গায় বাজার মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক মূল্যে জমি কিনেছেন। এর মাধ্যমে মোট ৮৫৮ কোটি টাকা লোপাট করেছে।

তার ব্যাখ্যায় বলা হয়, চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নজরুল ইসলাম তার শ্বশুর মফিজুল ইসলাম ও শ্যালক সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে ২০১৫ সালের ১২ মে ২৮ দশমিক ৫০ ডেসিমেল জমি কিনেছেন ১৭২ কোটি টাকায়। অথচ এক বছরের কিছু সময় আগে অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৮ জুলাই তারা এ জমি কিনেছেন মাত্র ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায়।

এভাবে বাজার মূল্যের চেয়ে জমি বাবদ চেয়ারম্যান তার শ্বশুর ও শ্যালককে ১৯৮ কোটি টাকার বেশি পাইয়ে দেন। শ্বশুর ও শ্যালক এ টাকা বুঝে পাওয়ার পর উপহার হিসেবে নজরুল ইসলামের স্ত্রী তসলিমা ইসলামের অ্যাকাউন্টে ১১৫ কোটি টাকা জমা দেন। আবার তসলিমা ইসলামও তার স্বামীকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন, যা তাদের ওই বছরের আয়কর নথিতেও উল্লেখ করা হয়।

বিএসইসির প্রতিবেদনে বলা হয়, একইভাবে ২০১৪ সালের ৩ মার্চ নজরুল ইসলামের দুই ভাই আজহার খান ও সোহেল খানের কাছ থেকে একটি বাড়িসহ ৩৩ দশমিক ৫৬ ডেসিমেল জমি ২০৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় কেনেন। দুই ভাইয়ের সঙ্গে নজরুল ইসলামও ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন।

অথচ একই জমি ২০১৪ সালের শুরুতে তার দুই ভাই মাত্র ২১ কোটি টাকা দিয়ে কেনেন। অর্থাৎ, ২১ কোটি টাকার জমি বিক্রি ফারইস্ট লাইফ কিনেছে ২০৭ কোটি টাকা দিয়ে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, নজরুল ইসলামের ভাই আজহার খান ১৫ দশমিক ৩ ডেসিমেল জমি ২০১৪ সালে মাত্র ১২ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় এবং সোহেল খান ১৮ দশমিক ২৬ ডেসিমেল জমি মাত্র ৮ কোটি ৭০ লাখ টাকায় কেনেন। এ জমি নজরুল ইসলামের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেছেন তারা।

বিএসইসি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই ধরনের লেনদেনের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ৪০৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা লোপাট করে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বিদেশে পাচার করেছেন।

কোম্পানির অর্থ লোপাটে অবদান রেখেছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালক এম এ খালেক। তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে ফারইস্ট লাইফের নামে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে মোট ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা আমানতের বিপরীতে ৩১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ নেন। এ ঋণ খেলাপি হয়। এরপর এ টাকা আমানত অর্থ দিয়ে সমন্বয় করা হয়।

শুধু তাই নয়, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১৩৬ কোটি টাকা ঋণ নেন এম এ খালেক। এরপর টাকা পরিশোধ করেননি। ফলে সুদসহ ১৮৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা করা হয় ফারইস্ট লাইফ থেকে। কারণ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ফারইস্টের গচ্ছিত আমানতকে তৃতীয় পক্ষের জামানত হিসেবে ব্যবহার করেন এম এ খালেক।

একইভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এম এ খালেক প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি, পিএফআই প্রপার্টিস, মিথিলা টেক্সটাইল, মিথিলা প্রপার্টিস এবং আজাদ অটোমোবাইলসের নামে নেওয়া ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েও পরিশোধ করেননি। কিন্তু এসব ঋণের বিপরীতে ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ফারইস্ট লাইফের আমানত থেকে ২৯৩ কোটি টাকা সুদে-আসলে কেটে নিয়েছে। এভাবে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ঋণের জামানত দিয়ে সেই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে ব্যাংকগুলো বিমা কোম্পানিটির আমানত থেকে অর্থ কেটে নিয়েছে। এতে ফারইস্টের মোট লোকসান হয়েছে ৯৭৭ কোটি টাকার বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএফআই সিকিউরিটিজ এবং প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন কোম্পানির নামে বাণিজ্যিক ব্যাংকে মোট ১৩টি মুদারাবা মেয়াদি আমানত (এমটিডিআর) রয়েছে। এগুলো ছিল পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এ হিসাব খোলার জন্য তারা পর্ষদ সভার রেজুলেশন জাল করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিটির পরিচালকরা ব্যাংকগুলো থেকে অনৈতিক ঋণ সুবিধা নিয়েছে। এর জন্য সহযোগিতা করেছে কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যখন তারা ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, ওই সময়ে ব্যাংকগুলো মুদারাবা মেয়াদি আমানত (এমটিডিআর) বাতিল করে দেয়৷ এ দুই ব্যক্তিকে সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন এমডি হেমায়েত উল্লাহ। তার বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন বাড়ি-গাড়ি এবং মোটা অংকের বেতন।

এ বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফারইস্ট লাইফের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে তদন্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বেশকিছু অনিয়ম দেখা গেছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

বিষয়টি নিয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি দেশে আছেন নাকি দেশের বাইরে আছেন কেউ তা বলতে পারছেন না। এম এ খালেক এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হেমায়েত উল্লাহর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত এমডি আলমগীর কবির কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এমআই/এসএসএইচ