আড়াই বছর লেগেছিল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষকের পদোন্নতির তালিকা যাচাই-বাছাই করতে। তারপরও হলো না। তীরে এসে আটকে গেল তরী। তালিকা আটকে দিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়।    

দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সাড়ে ৫ হাজার সহকারী শিক্ষককে প্রথমবারের মতো সিনিয়র সহকারী শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। তবে অভিযোগ উঠেছে, এ তালিকা তৈরিতে ঘুষ নেওয়া হয়েছে, নিয়মের বাইরে এসে তালিকায় ঢুকানো হয়েছে দেড় হাজার শিক্ষকের নাম। এসব অভিযোগ ওঠার পর শিক্ষামন্ত্রণালয় ওই তালিকা তো আটকে দিয়েছেই, বিষয়টি গড়িয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত।  

তাই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা প্রথমবারের মতো সিনিয়র সহকারী শিক্ষক পদে পদোন্নতির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আপাতত তা আর হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

তালিকা তৈরিতে ঘুষ নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সরাসরি জবাব না দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, এটা নিয়ে একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে, সেটা নিরসনে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত ডিপিসিতে (বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি) পদোন্নতি চূড়ান্ত হয়নি। পদোন্নতি চূড়ান্ত করতে আরও সময় লাগবে। 

নীতিমালা লঙ্ঘন করে পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিপিসিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রয়েছেন। তাদের পাশ কাটিয়ে পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ নেই। যোগ্য কোনো শিক্ষক তার প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হবেন না বলেও আশ্বাস দেন তিনি। 

২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকদের চাকরি বিধিমালার গেজেটে সিনিয়র শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। সহকারী শিক্ষকের মোট পদের ৫০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার কথা বলা হয় এতে। আরও বলা হয়, সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষক পদে অন্তত ৮ বছর চাকরি করতে হবে। 

এখন পর্যন্ত পদোন্নতি চূড়ান্ত হয়নি। পদোন্নতি চূড়ান্ত করতে আরও সময় লাগবে

মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক

গেজেটে বলা হয়, সহকারী শিক্ষক পদে চাকরিতে প্রবেশের পাঁচ বছরের ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) বা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (ডিপ ইন এডু) বা ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার এডুকেশন ডিগ্রি থাকতে হবে। তবে নানা কারণে অনেক শিক্ষক এই শর্তটি নির্ধারিত সময়ে পূরণ করতে পারেননি। এই শর্ত পূরণ না করা প্রায় দেড় হাজার শিক্ষককে পদোন্নতির তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ তালিকা তৈরিতে প্রায় অর্ধকোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয়েছে।

অভিযোগকারী শিক্ষকরা জানান, গোপনে সিনিয়র শিক্ষক বানাতে চেয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষকের একটি তালিকা করেছিল। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে তালিকা তৈরির অভিযোগ ওঠার পর ওই তালিকা আটকে দিয়েছে মন্ত্রণালয়। 

অভিযোগ ওঠার পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) নাজমুল হক খানের সভাপতিত্বে গত ১০ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের পদোন্নতি কমিটির সভা হয়। তাতে অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়নি। শিক্ষক নেতারা বলেছেন, পদোন্নতি পেতে হলে নিয়োগ বিধির শর্ত পূরণ করতে হবে। কিন্তু মাউশির একটি অংশ এই শর্ত মানতে রাজি নয়। তারা সহকারী শিক্ষক পদে যোগদানের তারিখ থেকে হিসাব করে পদোন্নতি দিতে চান।

শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সরকারি হাইস্কুলে কর্মরত মোট পদের ৫০ শতাংশ পদ সিনিয়র শিক্ষক অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির নন ক্যাডার পদ সৃষ্টি করা হয়। এরপর পদোন্নতির প্রক্রিয়া অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিল মাউশি। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি দিতে খসড়া গ্রেডেশন তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ তালিকায় পাঁচ হাজার ৮৫৪ শিক্ষকের নাম ছিল। তালিকার অসঙ্গতি বা আপত্তি থাকলে ওই বছরের ১৪ নভেম্বরের মধ্যে আবেদন পাঠাতেও বলা হয়েছিল শিক্ষকদের।

কিন্তু নীতিমালা নিয়ে কতিপয় শিক্ষক আপত্তি তুললে আটকে যায় সে প্রক্রিয়া। পরে সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে বিকল্প কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকা পাঠায় মাউশি।

মাউশির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সদ্য জাতীয়করণসহ সারাদেশে বর্তমানে ৫৩১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে পুরাতন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১৭টি। নতুন সরকারি করা অনেক স্কুলে পদসৃজন হয়নি। পুরাতন ৩০০টি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। আর জেলা শিক্ষা অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে ৩৩টি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৪২০ জন সহকারী শিক্ষককে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরমধ্যে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে ৩৬৮ জন ও সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে ৫২ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ পদোন্নতির পর বর্তমানে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে ১৪০টি। বর্তমানে সরকারি হাইস্কুলে ৮ হাজারের মতো শিক্ষক কর্মরত আছেন। আর বিভিন্ন পদ মিলিয়ে শূন্য রয়েছে আড়াই হাজার। শূন্য পদে ১ হাজার ৯৯৯টি পদে সরাসরি নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দীন মাহমুদ সালমী বলেন, যেহেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে সুষ্পষ্ট মতামত দিয়েছে সুতরাং তারই আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ৫ হাজার সহকারি শিক্ষকের পদোন্নতি দিতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ যেমন বাস্তবায়ন হবে পাশাপাশি ৩০ বছর ধরে পদোন্নতি না পাওয়া শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যেতে পারবেন।

এনএম/এনএফ