প্রতি বিসিএসে লাখো চাকরিপ্রত্যাশী অংশ নেয় ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নে

সরকারি কলেজে শিক্ষক সংকট দূর করতে আসছে শিক্ষা ক্যাডারের ‘বিশেষ বিসিএস’। বিভিন্ন সরকারি কলেজে ৩ হাজার ৫৮৫টি পদ শূন্য রয়েছে। দ্রুত এসব পদ পূরণে ‘বিশেষ বিসিএস’ নেওয়ার প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে শূন্য পদ পূরণের অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা যায়, গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-২ (অতিরিক্ত সচিব) আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শূন্য পদ পূরণে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতার বিভিন্ন দপ্তরের শূন্য পদের তালিকা ও নিয়োগের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, সরকারি কলেজে ৩ হাজার ৫৮৫টি প্রভাষক (শিক্ষা ক্যাডার) পদে শিক্ষক নেই।

এসব শূন্য পদ পূরণে বিশেষ বিসিএস নেওয়া যায় কিনা তা যাচাই-বাছাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) এ সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৫ জানুয়ারি মধ্যে একটি প্রস্তাব তৈরির নির্দেশ দেয়।

সরকারের নীতি হলো মুজিববর্ষে সরকারি পদ শূন্য রাখা যাবে না। এ লক্ষ্যে গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক বৈঠকে শিক্ষায় বিশেষ বিসিএস নেওয়া যায় কিনা এমন নির্দেশনা দিয়েছে।

মো. মাহবুব হোসেন, সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তথ্য যাচাই-বাছাই করে দ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে বৈঠকে তা চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। 

এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের নীতি হলো মুজিববর্ষে সরকারি পদ শূন্য রাখা যাবে না। এ লক্ষ্যে গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক বৈঠকে শিক্ষায় বিশেষ বিসিএস নেওয়া যায় কিনা এমন নির্দেশনা দিয়েছে।  

তিনি জানান, শূন্য পদ পূরণে বিশেষ বিসিএস নেওয়া যায় কিনা তা মাউশিকে জানাতে বলা হয়েছে। অধিদপ্তরের মতামত পেলে তা চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তারা পাবলিক সার্ভিস কমিশনে পাঠাবে।

ইতোমধ্যে ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে ৪ হাজার ৭৯২জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৪২তম বিসিএসে আরও সহকারি সার্জন নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষা ক্যাডারসহ অন্যান্য প্রফেশনাল ক্যাডারে শূন্য পদ পূরণে মন্ত্রণালয় বিশেষ বিসিএসের প্রস্তাব দিলে আমরা তাতে সাড়া দেবো।

সোহরাব হোসাইন, চেয়ারম্যান, পাবলিক সার্ভিস কমিশন

এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও কলেজ) শাহেদুল খবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছি। শূন্য পদগুলোর জন্য বিশেষ বিসিএস নেওয়া যায় কিনা তা যাচাই-বাছাই চলছে। দ্রুত মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেওয়া হবে।  

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সাধারণ বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত না। এতে সারাদেশে সরকারি কলেজগুলো শিক্ষক সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে।

এর আগে সরকারি কলেজগুলোর শূন্য পদ পূরণে ১৪, ১৬ এবং ২৬তম এ তিনটি বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেসব বিসিএসে প্রিলিমিনারি এবং মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিসিএসে সফল হতে দরকার দীর্ঘ ও পরিকল্পিত প্রস্তুতি

কতটা প্রয়োজন বিশেষ বিসিএসের?

মাউশির সরকারি কলেজ শাখার তথ্যমতে, ৩৮, ৪০ ও ৪১তম এ তিনটি বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগে মোট ২ হাজার ৭৪০টি পদের চাহিদা দেওয়া হয় পিএসসির কাছে। এরমধ্যে ৩৮তম বিসিএসে ৯৫৫, ৪০তম বিসিএসে ৮৭০ এবং ৪১তম বিসিএসে ৯১৫টি পদের বিপরীতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে পিএসসি।

৩৮তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীদের চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন চলছে। খুব শিগগিরই এ বিসিএসে নিয়োগের চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

অন্যদিকে ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চলতি মাসের শেষে ফল প্রকাশের কথা রয়েছে। আর ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবে আগামী ১৯ মার্চ।

এ তিনটি বিসিএসের মধ্যে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে সর্বোচ্চ ৩৮তম বিসিএসের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে। অন্য দুটি দুটি বিসিএসের প্রক্রিয়া শেষ করতে আরও দেড় বছর লেগে যাবে। এ অবস্থায় শূন্য পদ পূরণ করতে হলে বিশেষ বিসিএস ছাড়া অসম্ভব।

বিসিএস আয়োজন প্রক্রিয়া ও ফল প্রকাশে ধীরগতি রয়েছে পিএসসির 

এ প্রসঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতোমধ্যে ৩৯তম বিসিএসের মাধ্যমে ৪ হাজার ৭৯২জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৪২তম বিসিএসে আরও সহকারি সার্জন নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। শিক্ষা ক্যাডারসহ অন্যান্য প্রফেশনাল ক্যাডারে শূন্য পদ পূরণে মন্ত্রণালয় বিশেষ বিসিএসের প্রস্তাব দিলে আমরা তাতে সাড়া দেবো।

পিএসসি কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে হলে বিধিমালা সংশোধনসহ যাচাই-বাছাই কার্যক্রমে ছয় মাস প্রয়াজন। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে বিশেষ বিসিএস আয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পিএসসিতে এখনও কোনো চাহিদা পাঠানো হয়নি। তবে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য চাহিদা পাঠানো হচ্ছে। সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের চাহিদাও রয়েছে। তারপরও যদি শিক্ষা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশেষ বিসিএস নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে তবে তারা নিতে প্রস্তুত। 

বিশেষ বিসিএসের যত বিড়ম্বনা

বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে কর্মকর্তা নিয়োগে সাধারণ বিসিএস বিধিমালা সংশোধন করতে হয়। কারণ সাধারণ বিসিএসে তিনটি ধাপ প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা হয়। কিন্তু বিশেষ বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা হয় না। প্রিলিমিনারির পর সরাসরি মৌখিক পরীক্ষা হয়। সর্বশেষ ৪৩তম বিশেষ বিসিএসের সার্কুলার হয়েছে। এরমধ্যে ৯টি বিসিএস বিশেষ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, পুলিশ ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা এসব বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন।

বিশেষ বিসিএসে পদোন্নতি জটিলতা

বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে একই ক্যাডারের বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। কারণ ব্যাচভিত্তিক কর্মকর্তা বেশি হওয়ায় তাদের পদোন্নতিতে বৈষম্য তৈরি হয়।

শিক্ষা ক্যাডারে সবচেয়ে বড় ব্যাচ ১৪তম। এ বিসিএসের মাধ্যমে ১ হাজার ৪০০’র বেশি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালে নিয়োগ পাওয়া এ ব্যাচের কর্মকর্তারা সর্বশেষ ২০১৮ সালে অধ্যাপক হয়েছেন। সহকারী, সহযোগী এবং অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। সর্বশেষ অধ্যাপক পদে পদোন্নতি শুরু হয় ২০১৪ সালে। শেষ হয় ২০১৮ সালে। যোগ্য হওয়ার পরও শুধু বেশি প্রার্থী হওয়ায় পদোন্নতিতে জটিলতা তৈরি হয়।

করোনায় হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট দেখা দিলে তা পূরণে উদ্যোগী হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। শূন্য পদ পূরণে ৩৯তম বিসিএসের (বিশেষ) আয়োজন করে পিএসসি। ২০০ নম্বরের এমসিকিউ এবং ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত সময়ে পাঁচ হাজারের মতো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে দুই হাজার সহকারী সার্জন নিয়োগ দেওয়া হবে। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি এ বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবে। 

এনএম/এসআরএস