এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রভাষকদের পদোন্নতির দীর্ঘদিনের ‘কালো’ বিধিমালা বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী আট বছর সন্তোষজনক চাকরির পূর্তিতে প্রভাষকদের অর্ধেককে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। এমপিও নীতিমালায় ১০০ নম্বরের নয়টি সূচক নির্ধারণ করা হলেও নম্বর বণ্টন করা হয়নি।

মঙ্গলবার সর্বশেষ সভা করে প্রতিটি সূচকের বিপরীতে নম্বর বণ্টন করে পদোন্নতির নীতিমালা প্রায় চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) নয়টি অঞ্চলের পরিচালকের নেতৃত্বে মানদণ্ড যাচাই-বাছাই করে পদোন্নতি দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) ফৌজিয়া জাফরীন বলেন, এমপিও নীতিমালার আলোকে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির নীতিমালা প্রণয়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলেই পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু হবে।

প্রভাষকদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষদের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ থাকবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার সনদ, জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ প্রকাশসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হবে। সৃজনশীল বিষয়ে কর্মকাণ্ডের নম্বর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অধ্যক্ষদের পছন্দমতো নম্বর দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।   

গত ২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ জারি করে। এ নীতিমালার অনুচ্ছেদ ১১.৬ অনুযায়ী আট বছর সন্তোষজনক চাকরির পূর্তিতে নয়টি মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রভাষক থেকে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। 

এক্ষেত্রে কর্মরত প্রভাষকদের অর্ধেককে উচ্চমাধ্যমিক কলেজে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ও ডিগ্রি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। তবে চাকরির বয়স ১৬ বছর হলে সব প্রভাষক পদোন্নতি পাবেন। এ নীতিমালা জারির আগে উভয় স্তরের কলেজে মোট কর্মরত প্রভাষকদের অনুপাত প্রথার ভিত্তিতে অর্থাৎ ৫ অনুপাত ২ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হতো। অনুপাত প্রথার কারণে অনেক শিক্ষক পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে চলে যেতেন। অনেক প্রভাষক পুরোনো কলেজে চাকরি করায় পদোন্নতি বঞ্চিত হতেন। তাদের পরে চাকরিতে যোগ দিয়েও নতুন কলেজের প্রভাষকরা সহকারী অধ্যাপক হতেন। অনেক প্রভাষকের শিক্ষার্থী পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হয়েছেন। অনুপাত প্রথা বাতিলের দাবিতে যুগের পর যুগ শিক্ষকরা আন্দোলন করে আসছেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন এমপিও নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।

পদোন্নতিতে ১০০ নম্বরের মূল্যায়নে সূচক 

জ্যেষ্ঠ প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মোট ১০০ নম্বরের মূল্যায়নে সূচকগুলো হলো, এমপিওভুক্তির জ্যেষ্ঠতা ১৫ নম্বর, একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফলে ১৫ নম্বর, ক্লাসে মোট উপস্থিতির জন্য ২০ নম্বর, এমপিওভুক্তির পর থেকে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য/বিরূপ রেকর্ড না থাকলে ১০ নম্বর, বিভাগীয় মামলা না থাকলে পাঁচ নম্বর, প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকে অনুকরণীয়/সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য ১০ নম্বর, ভার্চুয়াল ক্লাস নেওয়ার দক্ষতার ওপর ১০ নম্বর, উচ্চতর ডিগ্রির (এমফিল বা পিএইচডি) জন্য ৫ নম্বর, গবেষণা কর্ম বা স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য ১০ নম্বর। মূল্যায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ কর্তৃক একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি সূচকগুলো মূল্যায়ন করে পদোন্নতি দেবে। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা থাকলে পদোন্নতি দেওয়া হবে না।

১০০ নম্বরের নয়টি সূচকের নম্বর কিভাবে নির্ধারণ করা হবে তা পদোন্নতির নীতিমালা কমিটি প্রায় চূড়ান্ত করেছে। গত মঙ্গলবার কমিটির সভায় অংশ নেওয়া একধিক সদস্য জানান, এমপিও প্রাপ্তি থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের জন্য আটটি উপসূচক নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ এমপিওভুক্তির আট বছর পূর্ণ হলে আট নম্বর, নয় বছর পূর্ণ হলে নয় নম্বর, ১০ বছর পূর্ণ হলে ১০ নম্বর, ১১ বছর পূর্ণ হলে ১১ নম্বর, ১২ বছর হলে ১২ নম্বর, ১৩ বছর পূর্তিতে ১৩ নম্বর, ১৪ বছর পূর্ণ হলে ১৪ নম্বর, ১৫ বছর পূর্ণ হলে ১৫ নম্বর।

শিক্ষাগত যোগ্যতার ফলাফলের নম্বর বিভাজনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এসএসসি বা সমমান পরীক্ষার জন্য তিন নম্বর। এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ প্রাপ্তরা তিন নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ প্রাপ্তরা দুই নম্বর, তৃতীয় বিভাগ প্রাপ্তরা এক নম্বর পাবেন। এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় পাসের জন্য তিন নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথম বিভাগ প্রাপ্তরা পাবেন তিন নম্বর, দ্বিতীয় বিভাগ  প্রাপ্তরা দুই নম্বর, তৃতীয় বিভাগ প্রাপ্তরা এক নম্বর পাবেন। 

ডিগ্রি পাস/ স্নাতক (পাস) বা সমমান পরীক্ষায় পাসের জন্য ছয় নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ স্তরে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্তরা পাবেন ছয় নম্বর, দ্বিতীয় শ্রেণি প্রাপ্তরা পাঁচ নম্বর, তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্তরা পাবেন চার নম্বর। অনার্স বা সমমান (চার বছরের কোর্স) পাস সনদের জন্য আট নম্বর। এ স্তরে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্তরা পাবেন আট নম্বর, দ্বিতীয় শ্রেণি প্রাপ্তদের জন্য সাত নম্বর। তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্তদের জন্য রয়েছে পাঁচ নম্বর। 

ডিগ্রি (পাস) বা তিন বছরের অনার্সসহ মাস্টার্সের ক্ষেত্রে তিন নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এ স্তরে প্রথম শ্রেণি বা সিজিপিএ-৩ প্রাপ্তির জন্য তিন নম্বর, দ্বিতীয় শ্রেণি বা সিজিপিএ-২ এর জন্য দুই নম্বর। চার বছরের অনার্সসহ মাস্টার্স পাসের জন্য নয় নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সিজিপিএ ভিত্তিক নম্বর নির্ধারণ করা হয়নি। বিভাগ বা শ্রেণির সমমান সিজিপিএ নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী নম্বর নির্ধারণ করা হবে। চার বছরের অনার্স পাস করা প্রভাষকদের জন্য মাস্টার্স নম্বর বণ্টন প্রযোজ্য হবে না। 

ক্লাসে মোট উপস্থিতির নম্বর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারণ করা ক্লাস রুটিন অনুযায়ী প্রভাষকদের জন্য বরাদ্দকৃত ক্লাসে উপস্থিতি অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হবে। শতভাগ শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির জন্য ২০ নম্বর, ৯৯ ভাগ উপস্থিতির জন্য ১৮ নম্বর, ৯৮ ভাগ উপস্থিতির জন্য ১৬ নম্বর, ৯৭ ভাগ উপস্থিতির জন্য ১৪ নম্বর, ৯৬ ভাগ উপস্থিতির জন্য ১২ নম্বর, ৯৫ ভাগ উপস্থিতির জন্য ১০ নম্বর, ৯৪ ভাগ উপস্থিতিতে আট নম্বর, ৯৩ ভাগ উপস্থিতির জন্য ছয় নম্বর, ৯২ ভাগ উপস্থিতির জন্য চার নম্বর, ৯১ ভাগ উপস্থিতির জন্য দুই নম্বর, ৯০ ভাগের  নিচে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান করলে শূন্য নম্বর দেওয়া হবে।

প্রভাষকদের এমপিওভুক্তির পর থেকে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য বা বিরূপ রেকর্ড না থাকলে ১০ নম্বর দেওয়া হবে। কলেজ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রভাষকদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলে পাঁচ নম্বর দেওয়া হবে।

প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকে অনুকরণীয় বা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য ১০ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ড বলতে, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণামূলক কার্যক্রম, একাডেমিক পরিবেশ সৌহার্দপূর্ণ রাখা, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে কার্যক্রম, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, রোভার স্কাউট, গার্লস গাইড, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক নিরাপত্তাজনিত কার্যক্রম ইত্যাদি। এসব কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রমাণ থাকতে হবে। কলেজ গভর্নিং বডি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মাউশি অধিদফতরকে অবহিত করতে হবে। প্রভাষকদের এসব দক্ষতা অনুযায়ী অধ্যক্ষ মূল্যায়ন করবেন।

ভার্চুয়াল ক্লাস নেওয়ার দক্ষতার জন্য ১০ নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভার্চুয়াল ক্লাসের সংখ্যা, ক্লাস নেওয়ার প্ল্যাটফর্ম; ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির সক্ষমতা, ক্লাসে উপস্থাপনা বা কৌশল, ক্লাসে উপস্থাপিত তথ্য, ছবি, উদাহরণ ইত্যাদির ওপর নম্বর নির্ধারণ করা হবে।

উচ্চতর ডিগ্রি (এমফিল বা পিএইচডি) থাকলে পদোন্নতিতে পাঁচ নম্বর দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কি না; ডিগ্রির গবেষণার বিষয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হবে। এছাড়া গবেষণাকর্ম বা বিভিন্ন জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে ১০ নম্বর দেওয়া হবে। জার্নাল বা ম্যাগাজিনের নাম, গবেষণা কর্মের শিরোনাম, গভর্নিং বডির অনুমোদন, গবেষণা কর্মের বিষয়ের নামের ওপর নম্বর দেওয়া হবে।

নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, সারা দেশে বর্তমানে দুই হাজার ৫২৪টি উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। একটি মাত্র কমিটির পক্ষে সব প্রতিষ্ঠানের প্রভাষকদের পদোন্নতি কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে একই নীতিমালা অনুযায়ী মাউশির নয়টি অঞ্চলভিত্তিক কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। কমিটিতে মাউশি কর্তৃক মনোনীত একজন সরকারি ও একজন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সদস্য থাকবেন। তাদের মূল্যায়নের পর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের পরিচালক যাচাই করে পদোন্নতি দেবেন।  

এনএম/আরএইচ