ইমন চৌধুরী, ছবি : সাইফুল রাজু

দেশ জুড়ে সবার মুখে মুখে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গান। বহুল আলোচিত ‘হাওয়া’ সিনেমার এই গান নিয়ে বিভিন্ন বয়সের শ্রোতাদের মধ্যে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে। গানটির পেছনের কারিগর ইমন চৌধুরী। তরুণ প্রজন্মের মেধাবী এ সংগীত পরিচালক বরাবরই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। একের পর এক গানে সুর ও মিউজিকের জাদু ছড়িয়ে মুগ্ধ করছেন সবাইকে।

শ্রাবণের এক বিকেলে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন ইমন চৌধুরী। কথা বলেছেন ভাইরাল হওয়া ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানসহ তার সংগীত জীবনের নানান বিষয় নিয়ে।

হাওয়া সিনেমায় আপনার মিউজিক করা সাদা সাদা কালা কালা গানটি এখন দেশ জুড়ে ভাইরাল। কেমন লাগছে?

সত্যিই খুব ভালো লাগছে। অনেকেই নিজের মতো করে গানটি গাইছেন, নিজের করে নিয়েছেন। যখন দেখি আমার সংগীতায়োজনের একটি গান সবাই দলে দলে গাচ্ছে, তখন এটাকে বড় প্রাপ্তি বলেই মনে হয়। সবচেয়ে ভালো প্রতিক্রিয়া হলো, যখন বাইরে যাই, রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জায়গায় গানটি বাজতে শুনি। তখন মনে হয় এতদিন ধরে গানটি করা সার্থক হয়েছে।

গানটি তৈরির প্রেক্ষাপট জানতে চাই। এর মিউজিকে একটি বাদে সব অপেশাদার যন্ত্র বাজিয়েছেন। কীভাবে এই ভাবনায় মাথায় আসে?  

এটার মূলে আছেন মেজবাউর রহমান সুমন ভাই, যিনি এই সিনেমার নির্মাতা। সিনেমার শুটিংয়ের আগে তিনি আমাকে গানটির প্রেক্ষাপট বুঝিয়ে দেন। সঙ্গে এ-ও জানিয়ে দেন, এতে প্রচলিত কোনো বাদ্যযন্ত্র যাতে না বাজাই। কারণ মাছ ধরার ট্রলারে সাধারণত বাদ্যযন্ত্র থাকার কথা না। ওনার দুটো চাওয়া ছিল এই গান নিয়ে। প্রথমত এটি হতে হবে একদম ন্যাচারাল। আর দ্বিতীয় হলো- গানটি বাজার সময় সিনেমা হল যেন কেঁপে ওঠে। সাউন্ড যেন এপিক হয়। তখন চিন্তায় পড়ে গেলাম, হাতের কাছে থালাবাসন, কলস-টলস দিয়ে আর কতটুকু এপিক করা যাবে। এরপর অনেক সময় নিয়ে গবেষণা করেছি, নৌকায় গিয়ে ঘুরেছি, সেখানকার বিভিন্ন অনুষঙ্গের সাউন্ড শোনার চেষ্টা করেছি। সেসব সাউন্ডের জন্য দোকানে দোকানে গিয়ে গিয়ে কলস, প্লাস্টিকের ড্রামসহ বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করেছি। এই কাজটিতে মিথুন চক্র দাদা যুক্ত থাকায় আমার জন্য কাজটি সহজ হয়ে যায়। তিনি এসব অযন্ত্রকে বাজানোর দায়িত্ব নেন। তিনি ছাড়াও আরও অনেক গুণী গুণী মিউজিশিয়ান এই গানে কাজ করেছেন। এই গানে আমরা আসলে কোনো কিছুর কমতি রাখিনি। মানুষের পা এবং নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত রেখেছি। কারণ একজন মানুষ যখন নৌকায় বসে বা দাঁড়িয়ে গান করবেন, তখন তার নিঃশ্বাসেরও কিন্তু একটা সাউন্ড থাকবে। তিন বছর ধরে গানটা তৈরি করেছি, শত শত ট্র্যাক রেকর্ড করেছি। এরপর আমজাদ ভাই ও রাশেদ শরীফ শোয়েব ভাই মিক্সিং ও মাস্টারিং করেছেন। শিবলু ভাই দারুণ গেয়েছেন। সব মিলে আমি বলব, এটি একটি টিম ওয়ার্ক। প্রত্যেকের অসামান্য চেষ্টায় এই গান হয়েছে।

রায়হান রাফী পরিচালিত পরাণ সিনেমায় আপনার গাওয়া, সুর-সংগীত করা ধীরে ধীরে গানটিও তো বেশ প্রশংসা কুড়াচ্ছে।

অনেকদিন পর প্লেব্যাকে কণ্ঠ দিয়েছি। এখানে আমার সঙ্গে গেয়েছেন লুইপা আপু। আর গানটি লিখেছেন আমার খুব প্রিয় গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবন। তার কথায় গান করতে আমি বরাবরই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এই গানটি আমার হৃদয়ের খুব কাছের। প্রকাশের পর থেকে অনেক প্রশংসা পেয়েছি। আমার মনে হয়, গানটি যারা শুনবেন, তারা তাদের প্লে লিস্টে এটা রেখে দেবেন। কারণ গানটিতে একটা শান্তি আছে। আমি নিজেও অনেক শুনি।

ক্যামেরার সামনে ইমন

সিনেমায় কি তাহলে নিয়মিত গান গাইবেন?

আমার মূল যে পরিচয়, গিটারিস্ট; এই সত্তাটাকে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এরপর সংগীত পরিচালনা, তারপরে গান গাওয়া। সে হিসেবে আমি কমই গান গাই। সামনেও যে অনেক গাইব, এমন না। মাঝেমধ্যে গাইব।

সামনে কোন কোন সিনেমায় কাজ করছেন?

খুব অসাধারণ একটি সিনেমার কাজ করছি। নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম ভাইয়ের স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘কাজলরেখা’র সংগীত পরিচালক হিসেবে আমি থাকছি। এখানে অনেকগুলো গান থাকছে। এটি একটি মিউজিক্যাল ফিল্ম। এখানে মিউজিকের অনেক বেশি উপস্থিতি থাকবে। এমন প্রজেক্টে কাজ করা যেকোনো মিউজিক ডিরেক্টরের জন্য স্বপ্নের মতো। এজন্য সময় নিয়ে খুব যত্নের সঙ্গে কাজটি করছি। এছাড়া ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’ সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও কয়েকটা গান করেছি। আরেকটা সিনেমার কাজ করেছি- ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’। এর বাইরে আরও কিছু সিনেমা নিয়ে কথা চলছে, ওয়েব ফিল্মেও কাজ করছি।

পরাণ সিনেমায় ধীরে ধীরে গেয়েছেন। আপনার গাওয়া গান-জিঙ্গেল হিট হয়েছে। তারপরও গায়ক হিসেবে কম পাওয়া যায় কেন?

গান গাওয়ার জন্য অনেকেই বলেন। কিন্তু আমি আসলে নিজেকে একজন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে ভাবতে ভালোবাসি। সংগীত পরিচালনা ও ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাতেই বেশি ভালো লাগে আমার। আর মাঝেমধ্যে গান গাইতে ভালো লাগে, সবসময় না। গান গাইতেই হবে, এমনটা মনে করি না। আমার যখন ভালো লাগে, তখনই মূলত গাই।

আপনার স্টুডিও জুড়ে যন্ত্র আর যন্ত্র? বাদ্যযন্ত্রের প্রতি এই আসক্তি কীভাবে এলো?

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সংগীত পরিবারেই। বাবা-মা দু’জনই সংগীতের শিক্ষক। সেই সূত্রে ছোটবেলা থেকেই গিটারের প্রতি আমার ভালো লাগা জন্মায়। ওই গিটার থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের প্রতিও ঝোঁক বাড়ে।

প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার হাতে

আপনি একাই একটা ব্যান্ড করেছেন। সেটা সম্পর্কে জানতে চাই

‘ওয়ান ম্যান ব্যান্ড’ বিভিন্ন দেশে আছে। ইনস্ট্রুমেন্টাল অনেক শো হয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তবে বাংলাদেশে এই চর্চাটা নেই বললেই চলে। আমি সেই অপূর্ণতার জায়গাটা পূর্ণ করতে চাই। সেই ভাবনা থেকেই ব্যান্ড করেছি এবং ইনস্ট্রুমেন্টাল করে যাচ্ছি।

সংগীত পরিচালনার ক্ষেত্রে কাউকে ফলো করেন? এই সময়ের কার কাজ বেশি ভালো লাগে?

কাউকে অনুসরণ নয়, বরং অনুপ্রাণিত হই। আর অনুসরণ করি বলতে আমাদের শেকড়, বাংলাদেশের মূল সংগীত ইতিহাসকেই আমি ধারণ করার চেষ্টা করি। আর যারা ভালো কাজ করেন, তাদের প্রত্যেকের কাজই আমার কাছে ভালো লাগে।

আপনার কাছে সংগীত মানে কী? কেন আপনি গান করেন?

সংগীত মানে প্রশান্তির বিষয়। যতক্ষণ সংগীতে থাকি, ভালো থাকি। আমার বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে সবকিছুই সংগীতকে ঘিরে। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়া, যেন সারাজীবন সুরময় একটা ভুবনেই থাকতে পারি।

কেআই/আরআইজে