ঢাকাই সিনেমার মিষ্টি মেয়ে চিত্রনায়িকা পরীমণি। মিলিয়ন মিলিয়ন ফ্যান-ফলোয়ার অনন্য সুন্দরী এই নায়িকার। সাদামাটা ছবি আপলোড করলেও হুমড়ি খেয়ে পড়ত অনুসারীরা। আবার কমেন্ট বক্সে উঠত মন্তব্যের ঝড়। 

সেই পরীকে নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে। বর্তমানে তিনি রয়েছেন পুলিশি রিমান্ডে। মাদক মামলায় গ্রেফতারের পর তার রিমান্ড চলছে। তার মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। 

বোট ক্লাবের ঘটনার রেশ না কাটতেই র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন পরীমণি। গত ৪ আগস্ট চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে নিজ বাসা থেকে প্রথমে আটক করা হয় তাকে। পরে তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা হয়। মামলায় দুই দফা রিমান্ডে নেওয়া হয় তাকে। 

গ্রেফতার হওয়ার পর পরীমণিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। সিনেমার শিল্পীদের সংগঠন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিও পরীমণির সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত করে।

কিন্তু ধীরে ধীরে পরীর জন্য কথা বলছেন অনেকে। চাচ্ছেন ন্যায় বিচার। ‘জাস্টিস ফর পরীমণি’ লেখা পোস্টার ফেসবুকে শেয়ার করে প্রতিবাদ করছেন অনেকেই। 

বৃহস্পতিবার পরিচালক ইস্পাহানি আরিফ জাহানের ফেসবুক ওয়ালে এমন একটি পোস্টার দেখা যায়। এর আগে দেশের প্রখ্যাত গীতিকবি ও সুরস্রষ্টা প্রিন্স মাহমুদ পরীমণিকে ‘টানাহ্যাঁচড়া’ না করার অনুরোধ জানান। 

তিনি বলেন, ‘যেটুকু অন্যায় সে করেছে তার থেকে অনেক অনেক বেশি শাস্তি সে পেয়ে গেছে। এবার একটু দয়া করেন। আর যদি এখনও মনে হয় তার শাস্তি হয় নাই, তবে তিন্নির মতো কাচপুর ব্রিজের ওপর থেকে বস্তায় বেঁধে ছুড়ে ফেলে দেন অথবা তাকে মাটিতে অর্ধেক পুতে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলেন। তাও প্রতিদিন এমনভাবে টানাহ্যাঁচড়া করে এমন অপমান একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে আর নিতে পারছি না।’

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক কলামে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ফেরা রেহানা মরিয়ম নূরখ্যাত অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন লিখেছেন, ‘পরীমণির ঘটনা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বহিঃপ্রকাশ।’ 

বাঁধন লিখেছেন, ‘পরীমণির ক্ষেত্রে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে যা করা হচ্ছে সেটা ন্যাক্করজনক। এটাই সমাজের আসল চেহারা। এই মিডিয়া ট্রায়ালের কোনো দরকার ছিল না। আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, তবে প্রথমে প্রমাণ, এরপর বিচার, শাস্তি।’ 

এদিকে পরীমণির জন্য প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আহ্বান করেছেন শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান। ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আমি আসলে ২০ জন সাহসী মানুষ চাই শনিবার প্রেসক্লাবের সামনে, যারা বলবে মেয়েটার প্রতি অন্যায় হচ্ছে...!’

কবি জগদীশ বড়ুয়া পার্থ বৃহস্পতিবার পরীমণির মুক্তি চেয়ে মানববন্ধন করেছেন প্লেসক্লাবের সামনে। সেই মানববন্ধনের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। 

লেখিকা জান্নাতুন নাঈম প্রীতি লিখেছেন, ‘সে (পরী) প্রতীক সেই জঘন্য সমাজব্যবস্থার যেখানে মদ খাইলে চরিত্র নিয়া টানাটানি পড়ে, কিন্তু ঘুষ খাইলে কেউ চরিত্রের প্রশ্নও তোলে না! 

পরীমণি বোকা, ভীত, অনাথ, দোষী বা নির্দোষ যাইই হোন, বেশিরভাগ বাঙালির মনের ভাষা তার কারণেই নতুন করে আবিষ্কার করা গেছে। আবিষ্কার করা গেছে ধর্ম মতে পাপকে কেমন করে আইনের সাথে মিলিয়ে অপরাধের তকমা দেওয়া হয়।

যে সমাজের লোক এখনো পাপ আর অপরাধ আলাদা করতে শেখে নাই, তারা বে*শ্যা হইলে নারীকে সম্মান করতে পারবে- সেই আশা করা কি ঠিক হবে? আপনিই বলেন?’

লেখক ও নাট্যনির্মাতা মোস্তফা মনন লিখেছেন, ‘পরীমণির ঘটনা এবং আমজাদ হোসেনের ছোটগল্প কাল সকালে-এর অনেক মিল আছে। গল্পে দেখতে পাই, এক পাগলি প্রেগন্যান্ট হয়, পরিবারের সকলের চাপাচাপিতে সে বলে দেবে কে দায়ী এবং এই ঘটনা বলবে কাল সকালে। এই খবর সবাই জেনে যায়। এলাকাবাসী, পাশের গ্রামের মানুষ। সন্ধ্যার পর এক এক করে আসতে থাকে পাগলির কাছে, মুদি দোকানদার, স্কুল মাস্টার, পাড়ার বখাটে, মেম্বার। তারা একে একে করে গোপনে আসে, আর নানান উপহার দিয়ে বলে, আমার কথা বলিস না। শেষের দিকে গল্পের একটা করুণ পরিণতি হয়। পাগলিকে একজন বিশ্বাস করতে পারে না। সে মনে করে, পাগলি যদি সকালে বলে দেয়! তাই তাকে পেটে ছুরি মারে, পাগলি মারা যায়। কাল সকালে পাগলি বলতে পারেনা তার এই অবস্থার জন্য কে দায়ী।  পরীমণির ঘটনার সাথে এই অনেক গল্পের মিল। পরীমণি না জানি কার নাম বলে দেয়! কারা পরীমণির বাসায় যেত! সমাজের উচ্চস্তরের মানুষগুলো সংকটে আছে এবং মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। তারা পরীমণিকে করোনার চেয়ে বেশি ভয় পায়। এই জন্য জীবন্ত/মুক্ত পরীমণি তাদের জন্য হুমকি।’ 

চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক ও সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন লিখেছেন, ‘প্রতিহিংসার চেহারা খুব নোংরাই হয়। পরীমণির ক্ষেত্রে তা উৎকটভাবে দেখা যাচ্ছে। মদ ও মাদক এখানে অজুহাত মাত্র। গন্তব্য আদতে শিক্ষা দেয়া। জেদ এখানে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। 

পরীমণি ইস্যু হলেও দেখবার বিষয় পরী নয়। একজন নারীর সাথে কী কী ঘটছে, ঘটতে পারে তার একটা বেটার উদাহরণ চলমান পরিস্থিতি। মেরুদণ্ড সোজা করে একজন মানুষের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস না থাকাটা অত্যন্ত তুচ্ছ অস্তিত্বের লক্ষণ। এই তুচ্ছতা এতটাই তুচ্ছ যে তা কীটের মর্যাদারও নিচেই থাকে।’ 

তিনি আরও লিখেছেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ। মাথাপঁচা কাতারে কাতারে লোকজনের এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু না থাকাটা আমাদের সমাজের জন্য ভয়ানক বিপদের ব্যাপার।’

এইচকে