প্রয়াত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, ‘এলআরবি’র প্রতিষ্ঠাতা, গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ (১৮ অক্টোবর)। এমন দিনে এই ব্যান্ড আইকনকে নিয়ে কলম ধরেছেন তার গাওয়া প্রথমসহ অনেক গানের গীতিকবি, দীর্ঘদিনের সংগীত সহযোদ্ধা শহীদ মাহমুদ জঙ্গী

এক

বাচ্চুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৭৯-৮০-র দিকে। তখন চট্টগ্রামে আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সৈকতচারী’র জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সংগঠনটি মূলত কয়্যার গান পরিবেশন করত। বেশির ভাগ ছিল মৌলিক গান। কিছু কাভার গানও ছিল। 

আমাদের অনুষ্ঠানগুলো হতো চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির অডিটরিয়ামে। অনুষ্ঠানের দুই-তিন দিন আগে থেকেই, বিকালের দিকে শিল্পকলার মাঠে-সিড়িতে আমরা আড্ডা দিতাম। অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রস্তুতি নিতাম। সোলসের সব সদস্যসহ চট্টগ্রামের ভালো ভালো শিল্পীরা তখন ‘সৈকতচারী’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘সৈকতচারী’র এক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিলগ্নে বাচ্চু শিল্পকলা একাডেমিতে এলো। তার বয়স তখন ১৬-১৭ হবে। ঝাঁকরা চুল। নাদুস-নদুস শরীরের গড়ন। সোজা আমার কাছে এসে বলল, ‘আমার নাম বাচ্চু, আমি ফিলিংসে গিটার বাজাই। আপনার কাছে এসেছি একটি গানের জন্য। আমায় যদি একটি গান লিখে দিতেন, তবে সুর করার চেষ্টা করতাম।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বাচ্চু থামল। এই আলাপচারিতার পরে ‘হারানো বিকেলের গল্প বলি’ শিরোনামে তাকে একটি গান লিখে দিয়েছিলাম। পরে জানতে পারি বয়স অল্প হলেও, ও খুব ভালো গিটার বাজায়।

‘ফিলিংস’-এ বাজানোর আগে বাচ্চু ‘রিদম ৭৭’ ব্যান্ডে বাজাত। ‘রিদম ৭৭’ ও ‘ফিলিংস’-এ তার সঙ্গে কুমার বিশ্বজিৎ ছিল। এবং যতটুকু মনে পড়ে, শিল্পকলা একাডেমিতে সেদিন বাচ্চুর সঙ্গে বিশ্বজিৎও ছিল।

দুই

১৯৭৯ সালে সোলসের নিয়মিত লিড গিটারিস্ট সাজেদুল আলম বিদেশ চলে যান। তার স্থলে বিল্লু গিটারিস্ট হিসাবে যোগ দেয়। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর সে সোলস ছেড়ে দেয়। এই অবস্থায় বাচ্চুকে সোলসে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। সোলসের প্রথম অ্যালবাম তখনো বের হয় নাই। কিন্তু সোলসের বেশ কিছুটা নামডাক তখন হয়েছে। বাচ্চু এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি।

বাচ্চুর সোলসে প্রথম যোগদান খুব একটা সুখের হলো না। যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে, কিছু বিষয়ে ভিন্নমতের কারণে প্রথমবারের মতো তার সাথে সোলসের বিচ্ছেদ ঘটে। তবে অল্পদিনের মধ্যেই সব আবার ঠিকঠাকও হয়ে যায়। বাচ্চু সোলসে ফিরে আসে। তারপর ১০বছর একটানা সোলসেই কাটিয়ে দেয়।

তিন

বাচ্চুর ভাবনায় সবসময় সংগীতই ছিলো। আমরা হয়তো ক্রিকেট নিয়ে গল্প করছি, বাচ্চু থাকলে অবশ্যই আড্ডা গানে গিয়ে শেষ হবে। রুমে বসে আড্ডা বা রাস্তায় হাঁটার সময়, মাঠে বা অনুষ্ঠানে বাচ্চু থাকলে গানের প্রসঙ্গ আসবেই।

একবার সম্ভবত ১৯৮৫-৮৬ হবে, ‘সৈকতচারী’র কয়েকজন ফরেস্ট হিলে গেলাম। অনেকটা পিকনিকের মতো। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছি। বাচ্চু এসে পাশে বসল। উসখুস করছে। মনে হলো কিছু বলতে চাইছে। আমি ওর দিকে তাকাতেই বলল, জঙ্গী ভাই একটু ঐ দিকে যাবো। সে পাহাড়ের একটি দিক দেখিয়ে বলল।

আমি বললাম, যাও। সে বলল আমাকেও যেতে হবে। আমি বললাম, এখানে সবাই আছে। সবাইকে ছেড়ে কীভাবে যাবো। বাচ্চু বলল, ‘এই যাবো আর আসবো’।

শেষ পর্যন্ত ওর সঙ্গে যেতেই হলো। ও আমাকে পাহাড়ের একপাশে নিয়ে গেলো। বলল, ‘একটা গান সুর করতে ইচ্ছা করছে, বেশিক্ষণ লাগবে না। আপনি একটা-দুটো লাইন লিখে দেন, আমি সুর করি।’ আমি বললাম, সবার থেকে আলাদা হয়ে এখানে আসা ঠিক হয়নি। চলো ফিরে যাই। বাচ্চু বলল, ‘এই পাঁচ দশ মিনিট তারপর ফিরে যাবো।’ অগত্যা বসলাম। বাচ্চুর কাছে গিটার থাকেই। সে গিটারে টুংটাং করা শুরু করলো।

আমি এক লাইন লিখলাম ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’ এতটুকু লিখেই পাহাড়ের ঢালুতে আমার চোখ আটকে গেলো। দেখি অনেক ফুল পড়ে আছে ঘাসের ওপর। বাচ্চুকে বললাম, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’ অন্য দিন লিখবো। আজ অন্য গান লিখি, বলেই লিখলাম-

‘কী জানি কী এক দিন ছিল

ঘাসের দোলায় ফুল ছিল, 

এলিয়ে চুল তুমি ছিলে 

কী জানি কী এক দিন ছিল।”

এই গান লেখা ও সুর করা শেষে আড্ডায় এসে সবাইকে গান শোনানো হলো। সবাই খুশি হলো। ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’র কথা ভুলে গেলাম।

চার 

সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৯০ সাল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ব্যান্ড শো হবে। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোন টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। বিটিভির পক্ষ থেকে সেই সময়ের সব বিখ্যাত ব্যান্ডের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যান্ড একটি করে গান পরিবেশন করবে। সবাই তাদের শ্রেষ্ঠ গান নিয়েই অনুষ্ঠানে আসবে। ভেতর ভেতর সবার মধ্য একটা প্রতিযোগিতা কাজ করছিল। 

তবে সোলস ছিল সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়। কারণ তাদের মূল গায়ক তপন চৌধুরী তখন কোনো এক কারণে ব্যান্ডে অনুপস্থিত। টেলিভিশন বা মঞ্চে প্রায় সব গান তপনই গাইত। আর একটি বা দুইটি গানের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে তপন ছাড়া অন্য কারো গাওয়ার তো প্রশ্নই উঠত না। সেই প্রথম সোলস, তপন ছাড়া টেলিভিশনে সংগীত পরিবেশন করবে। সিদ্ধান্ত হলো, বাচ্চু গাইবে। বাচ্চুর সেটাই ছিল, প্রথমবারের মতো এককভাবে সোলসকে গানে প্রতিনিধিত্ব করা। নতুন একটি গান তৈরি করার সিদ্ধান্ত হলো। সেই সময় আমি ব্যক্তিগত কারণে চট্টগ্রাম ছিলাম। সোলসের সব সদস্য ভিন্ন ভিন্ন কারণে চট্টগ্রাম ছিল। টেলিভিশনে রেকর্ডিং’র একদিন আগে দুই মাইক্রোবাসে করে আমরা চট্টগ্রাম থেকে রওনা হলাম। একটিতে আমি, বাচ্চু, পার্থ ও রনি। অন্যটিতে সোলসের বাকি সবাই। পার্থ তার কিছুদিন আগে সোলসে যোগ দিয়েছে।

আমি বাচ্চু এক মাইক্রোতে উঠার উদ্দেশ্য, আমি গান লিখব, বাচ্চু সুর করবে। চেষ্টা করছি গানের কথা সাজাতে, কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। এই করতে করতে ঢাকার দিকে অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি। হঠাৎ বাচ্চু আমাকে বলল, ‘জঙ্গী ভাই, মনে আছে ফরেস্ট হিলে লিখেছিলেন, ’একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’।

আমি বললাম ওতো এক- দুই লাইন লিখেছিলাম মাত্র। বাচ্চু এবার পার্থর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, কেমন হয়? পার্থ বলল, ‘খুব ভালো হয়’। তারপর গাড়ির সবাই ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’ শেষ করার জন্য অনুরোধ করল। 

যাই হোক ঢাকা আসতে আসতে গান লেখা শেষ। ততক্ষণে ঢাকা শহরে রাত নেমেছে। রাতের খাবার খেয়ে হোটেল ব্লু-নাইলের ২১ নম্বর রুমে বাচ্চু বসল পার্থকে নিয়ে। বাচ্চু সুর করা শেষ করে সংগীতায়োজন করছে। পার্থ কি-বোর্ডে। সবকিছু গুছিয়ে আনতে আনতে সকাল। নাস্তা করেই সবাই গেলো বিটিভিতে রেকর্ডিংর জন্য। পরদিনই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার হলো। এই পরিবেশনার মাধ্যমে ব্যান্ডের গানের গায়ক হিসাবে বাচ্চুর অবস্থান অন্য উচ্চতায় উন্নীত হলো। একই সঙ্গে বাচ্চু রক গানের এক নবদিগন্তের সূচনা করল। 

পাঁচ 

বিটিভিতে ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’ সম্প্রচার হওয়ার মাস দুই-তিনেক পরে ব্লু-নাইল হোটেলের ১৪ নম্বর রুমে সোলসের মিটিং হচ্ছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছি। মাঝপথে বাচ্চুর সঙ্গে দেখা। সে ওপর থেকে নামছে। জড়িয়ে ধরলো আমাকে। তারপর আদ্র কন্ঠে বলল, ‘ভাই, সোলস ছেড়ে দিলাম। যাওয়ার সময় কিছুই নিলাম না, শুধু আপনার লেখা গান-‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’ ওদের থেকে চেয়ে নিলাম।

আমি বাচ্চুকে নিয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসলাম। বললাম, তুমি টোটাল মিউজিশিয়ান। তোমার চিন্তা কী? আরেকটা ব্যান্ড তৈরি করবে। সফল হবেই। একসময় বাচ্চু দোয়া চেয়ে বিদায় নিলো।

এই ঘটনার দুই-তিন মাসের মধ্যে, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গানটি সঙ্গে নিয়ে ‘এলআরবি’র আত্মপ্রকাশ ঘটে,বাকিটুকু ইতিহাস…।

[লেখক : নন্দিত গীতিকবি]

আরআইজে