প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালীন হারমোনিয়ামে গানের চর্চা শুরু। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতেন। স্বপ্নও ছিল গায়ক হওয়ার। কিন্তু সময়ের আবর্তনে হয়ে গেলেন গীতিকবি। কলমের খোঁচায় সৃষ্টি করলেন অনেকগুলো নন্দিত গান। এলআরবি, ফিলিংস, আর্ক কিংবা সোলসের মতো ব্যান্ডের গানে উঠে এসেছে তার রচিত কথামালা।

তিনি বাপ্পী খান। এ প্রজন্মের অনেকে হয়ত তাকে সেভাবে চেনেন না। কিন্তু বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণালী সময়ে যারা ছিলেন নিয়মিত শ্রোতা, তাদের কাছে বাপ্পী খানের নামটি অজানা নয়।

সফল এই গীতিকবির জন্ম ও বেড়ে ওঠা পটুয়াখালীর বাউফলে। তবে বেড়ে উঠেছেন রাজধানীর পুরানা পল্টন লেনে। যদিও ছোটবেলার প্রায় পুরোটা সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের হোস্টেলে। এরপর আবার বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ছাত্রাবাসে বসবাস। মোটের ওপর ছাত্রাবাসের শৃঙ্খল জীবনেই তার বড় হওয়া।

বাপ্পী খানের বাবা ছিলেন সংগীতশিল্পী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। তাই ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছোঁয়া পেয়েছেন। নজরুলগীতির মাধ্যমে তার গানের হাতেখড়ি হয়। এরপর দীক্ষা লাভ করেন রবীন্দ্রসংগীতেও।

মূলত গায়ক হতে চেয়েছিলেন বাপ্পী খান। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে ঢাকা কলেজের এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন ‘চাইম’ ব্যান্ডের আশিকুজ্জামান টুলুর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এরপর টুলুর সংগীতেই গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। বাজারে আসে তার অ্যালবাম। কিন্তু স্থায়ী গায়কীতে স্থায়ী হলেন না।

কেন? জবাবে বাপ্পী খান বললেন, ‘আমার ধারণা ছিল, ক্যাসেট বের হবার পর সবাই আমাকে চিনতে শুরু করবে। রাস্তা-ঘাটে চেহারা লুকিয়ে চলতে হবে। অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যাথা হয়ে যাবে। হা হা হা। দুই তিন মাস পরেও যখন এমনটা হলো না, আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। আসলে গানের জন্য না, বরং জনপ্রিয়তার জন্য গান করেছিলাম। নিয়তটাই ঠিক ছিলো না। তাই গান গাওয়া বন্ধ করলাম।’

অ্যালবাম প্রকাশের সময়টাতে সংগীতাঙ্গনের অনেকের সঙ্গেই পরিচয় ঘটে বাপ্পী খানের। এক্ষেত্রে একটি নাম বলতে হবে, জেমস। তার জন্য সুরের ওপর গান লেখা শুরু করেন বাপ্পী খান। এরপর আইয়ুব বাচ্চুর সান্নিধ্য এসে তার জন্যও রচনা করেন গানের কথা। ব্যাস, এভাবেই গায়ক বাপ্পী খান হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর গীতিকার।

আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠে ‘এখন অনেক রাত’, ‘গতকাল রাতে’, ‘সাড়ে তিন হাত মাটি’, ‘আবেগি কিছু স্বপ্ন’; জেমসের কণ্ঠে ‘ভুলবো কেমন করে’, ‘ইচ্ছের পালক’, ‘ঢাকার প্রেম’, ‘সাদা অ্যাসট্রে’ গানগুলো বাপ্পী খানের লেখা। এছাড়া তার কথায় সোলস ব্যান্ডের ‘এভাবে যদি’, ওয়ারফেইজের ‘নির্বাসন’, মাইলসের ‘মরুভূমি’, অর্থহীনের ‘না বলা কথা’ গানগুলো উল্লেখযোগ্য।

ব্যক্তিগত জীবনে আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে দারুণ সখ্য ছিল বাপ্পী খানের। তার জন্য অনেক গান লিখেছেন। সেই জার্নিটা শুরু হয়েছিল কীভাবে? বাপ্পী খান বললেন, “এলআরবির ডাবল অ্যালবামের রেকর্ডিংয়ের সময় বাচ্চু ভাই গান চাইলেন। আমি বললাম- ‘গান তো লেখা নেই, কিছু কবিতা আছে’। তিনি বললেন ‘সেগুলোই দে’। তিন দিন পরে ফোন করে আমাকে সারগাম যেতে বললেন। আমি গেলাম। ভেতরে গিয়ে, গান শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ‘পেনশন’ গানটি রেকর্ড হচ্ছিল সেদিন। এটিসহ ওই অ্যালবামে ‘এক কাপ চা’ ও ‘জীবনের মানে’ অর্থাৎ তিনটি গান রিলিজ হলো।’’

বাপ্পী খানের গানে প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে জীবনঘনিষ্ঠ অন্যান্য অধ্যায়। বিষয়ভিত্তিক গান লিখেই তিনি সফল হয়েছেন। ব্যতিক্রম সেই ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি প্রচুর গান শুনতাম। প্রেম ভালবাসার বাইরের জগতটা গানে উপেক্ষিত ছিল বলে আমার মনে হয়। তাই ভেবেছিলাম প্রেম ছাড়া অন্য যে বিষয় মাথায় আসবে বা নজরে আসবে, সেটা নিয়েই লিখবো। সেজন্য হয়ত ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বেশি লেখা হয়েছে। আয়োজন করে এমনটা হয়নি।’

এ সময়ের গানের কথা নিয়ে বাপ্পী খানের ভাষ্য, ‘খুবই ভালো ভালো গান হচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল জটিলতার কারণে বেশিদিন মানুষ মনে রাখছে না। উচ্চারণে ভয়াবহ ভাইরাস লেগেছে। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা গান হচ্ছে। যার জন্য শুনতে কষ্ট হচ্ছে। গান তো ভালোবাসার জিনিস। তার জন্য কষ্ট করে ক’জন এমন উচ্চারণের গান শুনবে বলুন। তবে কিছু গানের কথা খুবই চমৎকার।’

এখনো নিয়মিত গান লেখেন বাপ্পী খান। কিছু নতুন গানের কাজও চলছে। তবে সেগুলো কবে, কোথা থেকে প্রকাশ হবে, তা এখনও নিশ্চিত নন এই গীতিকার। লেখাটা মূলত তার স্বভাব ও অভ্যাস। তাই গান প্রকাশ হোক বা না হোক, বাপ্পী খানের শব্দেরা ঠিকই অন্তমিল খুঁজে নেয়।

কেআই/আরআইজে