জাতীয় চিড়িয়াখানার শেড নম্বর এল-৮। ভেতরে তিন ফুট উচ্চতার একটি পুরুষ গাধা। অন্য সব গাধার চেয়ে অনেক আস্তে হাঁটছে সে। পেটে ও পিঠে একাধিক ঘা, সেখানে বাসা বেঁধেছে মাছি আর পোকা। সেগুলো তাড়াতে ঘাড় ও লেজ নাড়ানোর চেষ্টা করছে, তবে সফল হচ্ছে না। সামনে জাম্বু ঘাস, সেটি খেতেও কষ্ট হচ্ছে তার।

চিড়িয়াখানার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, গাধাটির বেঁচে থাকার কথা নয়। বেঁচে থাকলেও চিড়িয়াখানায় দৃশ্যমান থাকা বা সার্ভিস দেওয়ার কথা নয়। তাকে দেখে খুব একটা খুশি হতে পারছেন না দর্শনার্থীরাও।

জানা গেছে, গাধাটি যখন চিড়িয়াখানায় আনা হয় তখন এর আয়ু ধরা হয় ২৫ বছর। অর্থাৎ ২৫ বছর পর তাকে প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকার কথা। এখন গাধাটির বয়স ২৭। অতিরিক্ত দুই বছর প্রদর্শন করার পরও তাকে একই খাঁচায় রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন >> গাধার সংখ্যায় বিশ্বে পাকিস্তান তৃতীয়

এমন অবস্থায় যেকোনো সময় পশুটি মারা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও চিড়িয়াখানার প্রাণীদের এমন ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা।

শুধু গাধা নয়, জাতীয় চিড়িয়াখানার অনেক পশু-প্রাণীকেই নির্ধারিত বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরও প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। তাদের কঙ্কালসার দেহ আর মুমূর্ষু অবস্থার দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কর্তৃপক্ষের। যদিও তাদের নিজেদের এক ধরনের যুক্তি ‘প্রস্তুত’ আছে এমন ঔদাসীন্যের পেছনে।

চিড়িয়াখানার অনেক প্রাণীকেই নির্ধারিত বয়স পার হয়ে যাওয়ার পরও প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে

সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা গেছে আয়ুষ্কাল থেকে অতিরিক্ত আড়াই বছর খাঁচায় থেকে বিরক্ত কান্তা নামে একটি নারী সিংহ (ভারতীয় সিংহী)। চিড়িয়াখানার সি-১০ (বি) শেডে থাকা কান্তার বয়স সাড়ে ১৭ বছর। গত ১৫ মে পশুটি একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। বয়সের কারণে হাড্ডিসার অবস্থা তার। সামনে গরুর মাংস ও পানি থাকলেও সেদিকে মন নেই। বেশির ভাগ সময় শুয়ে-বসে কাটে তার। গা জুড়ে কাঁপুনি। দর্শনার্থীদের ডাকেও তেমন একটা সাড়া দেয় না, শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে।

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৩৮ প্রজাতির প্রায় দুই হাজার ৭৯২টি প্রাণী আছে। গাধা ও কান্তার মতো ৭৭টি প্রাণী তাদের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল পার করেছে। দীর্ঘদিন দর্শনার্থীদের মন জয় করলেও এখন তারা ক্লান্ত, শ্রান্ত ও বিধ্বস্ত। বিধি অনুযায়ী এখন তাদের অপসারণ কিংবা ব্যথামুক্ত উপায়ে মেরে ফেলার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ

বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় বর্তমানে ১৩৮ প্রজাতির প্রায় দুই হাজার ৭৯২টি প্রাণী আছে। গাধা ও কান্তার মতো ৭৭টি প্রাণী এরই মধ্যে তাদের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল পার করেছে। দীর্ঘদিন দর্শনার্থীদের মন জয় করলেও এখন তারা ক্লান্ত, শ্রান্ত ও বিধ্বস্ত। বিধি অনুযায়ী এখন তাদের অপসারণ কিংবা ব্যথামুক্ত উপায়ে মেরে ফেলার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

গাধাটি যখন চিড়িয়াখানায় আনা হয় তখন এর আয়ু ধরা হয় ২৫ বছর। বর্তমানে গাধাটির বয়স ২৭ / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

তারা বলছে, যেহেতু গবেষণার উদ্দেশ্যে চিড়িয়াখানাটি ব্যবহার করা হয়, তাই এসব প্রাণী যতদিন বাঁচবে ততদিন পর্যন্ত তাদের লালন-পালন করা হবে।

চিড়িয়াখানার নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এখানে ‘বৃহৎ প্রাণী (তৃণভোজী)’ শাখায় ১০টির আয়ুষ্কাল পার হয়েছে। তাদের মধ্যে এল-১৬ শেডে থাকা পুরুষ জলবকের (ওয়াটারবাক) বর্তমান বয়স ১৮ বছর নয় মাস এবং স্ত্রী জলবকের বয়স ২২ বছর সাত মাস ১৫ দিন। অথচ তাদের আবদ্ধ অবস্থায় আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ বছর।

বিশ্বের অনেক দেশের চিড়িয়াখানা আইনে নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল শেষে প্রাণীদের ব্যথামুক্ত মৃত্যুর (পেইন-ফ্রি ডেথ) কথা বলা আছে। তবে বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা আইনে এমন কিছু বলা নেই। ফলে আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া প্রাণীদের আমৃত্যু খাঁচায় রাখা হচ্ছে

ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ শাখায় আয়ুষ্কাল পার করা প্রাণী রয়েছে ১৫টি। চিড়িয়াখানার আর-১০ শেডে থাকা পুরুষ অজগর সাপের বর্তমান বয়স ৩৩ বছর নয় মাস একদিন। অথচ এর আবদ্ধ অবস্থায় আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২১ বছর। অতিরিক্ত ওজন ও দৈর্ঘ্যের কারণে খাঁচায় ঠিক মতো নড়াচড়া করতে কষ্ট হচ্ছে অজগরটির। আর-১১ শেডে থাকা স্ত্রী অজগর সাপের বর্তমান বয়স ২৬ বছর এক মাস একদিন। এটির আবদ্ধ অবস্থায় আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২১ বছর।

আর-৯ শেডে অবস্থান করা অপর স্ত্রী অজগর সাপের বর্তমান বয়স ৩৪ বছর আট মাস একদিন। এটিরও আবদ্ধ অবস্থায় আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২১ বছর। এসএম-৫ শেডে থাকা পুরুষ অলিভ বেবুন-২ এর বর্তমান বয়স ২৬ বছর আট মাস। আবদ্ধ অবস্থায় এর আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২৫ বছর। এসএম-২৪ শেডে থাকা পুরুষ সাদা হনুমানের বর্তমান বয়স ২৬ বছর নয় মাস ১৪ দিন। এর আয়ুষ্কাল ১৫ থেকে ২০ বছর।

আয়ুষ্কাল থেকে অতিরিক্ত আড়াই বছর খাঁচায় থেকে বিরক্ত ভারতীয় সিংহী কান্তা / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এছাড়া রেপ্টাইল পুল শেডে থাকা পুরুষ ঘড়িয়ালের বর্তমান বয়স ৩৯ বছর ২৪ দিন; আবদ্ধ অবস্থায় এর আয়ুষ্কাল ২৯ বছর। এসএম-৪ শেডে থাকা স্ত্রী উল্লুকের বর্তমান বয়স ২৫ বছর এক মাস ১১ দিন; এর আয়ুষ্কাল ১৫ থেকে ২০ বছর। 

বি-২০ শেডে থাকা পুরুষ ইমু পাখির বর্তমান বয়স ২০ বছর দুই মাস সাতদিন। আবদ্ধ অবস্থায় এর আয়ুষ্কাল ১২ থেকে ১৫ বছর। বি-২২ শেডে থাকা পুরুষ কেশোয়ারির বর্তমান বয়স ৩০ বছর পাঁচ মাস ৩০ দিন। এটির আবদ্ধ অবস্থায় আয়ুষ্কাল ১৮ থেকে ২০ বছর। বি-২৭ শেডে থাকা দুটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী বেঙ্গল শকুনের বর্তমান বয়স ৪২ বছর ছয় মাস ৩০ দিন। আবদ্ধ অবস্থায় তাদের আয়ুষ্কাল ৩৫ থেকে ৩৮ বছর।

বিশ্বের অনেক দেশের চিড়িয়াখানা আইনে নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল শেষে প্রাণীদের ব্যথামুক্ত মৃত্যুর (পেইন-ফ্রি ডেথ) কথা বলা আছে। তবে বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা আইনে এমন কিছু বলা নেই। ফলে আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া প্রাণীদের আমৃত্যু খাঁচায় রাখা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিড়িয়াখানার এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশ চিড়িয়াখানা আইন- ২০০০' অনুযায়ী এ বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেটি মন্ত্রিসভায় আছে। আশা করা যাচ্ছে এ বছর পাস হবে। এরপর এসব পশুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
 
বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. মুজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আয়ুষ্কাল শেষে প্রাণীদের মেরে ফেলার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। পশুপাখিগুলো চিড়িয়াখানায় থাকবে কি না কিংবা এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কি না— এসব বিষয়ে এর আগে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া পশুপাখিগুলো যে সময় পর্যন্ত বাঁচবে, আমরা খাবার-দাবার দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখব।

আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া প্রাণীগুলো প্রাকৃতিক অবস্থায় মারা যাক- এমনটি চান প ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল হক / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

তিনি আরও বলেন, চিড়িয়াখানা সরকারের একটি বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে বিনোদন, শিক্ষা ও গবেষণা করা। চিড়িয়াখানা থেকে সরকারের লাভ করতে হবে— এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া প্রাণীদের খাবার আমরা লস (লোকসান) হিসেবে দেখি না। তাদের আমৃত্যু খাবার দেওয়া হয়। বরং আরও বেশি যত্ন নেওয়া হয়, যেন তারা আরও বেশিদিন বেঁচে থাকে।

প্রাণীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ারের (প ফাউন্ডেশন)  প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রাণীদের অধিকারের জায়গা থেকে বলতে চাই, একটা প্রাণী যখন প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়, তখন তাকে এনেসথেসিয়া দিয়ে মারা যায়। এটা ভেটেরিনারি মেডিক্যাল সাইন্সের একটা নিয়ম। কারণ, প্রাণীকে সাফার করানোটাও একটা অন্যায়। এমন প্রাণীর ক্ষেত্রে কোনো একজন চিকিৎসক ওই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিড়িয়াখানায় একটা প্রাণী তার জীবদ্দশায় এন্টারটেইন করে গেল। আয়ুষ্কাল শেষে সে প্রদর্শনযোগ্য নয়। তাকে আপনি এনেসথেসিয়া দিয়ে মেরে ফেলবেন, এটাও ঠিক নয়। আমরা চাই প্রাণীটি প্রাকৃতিক অবস্থায় মারা যাক। আমৃত্যু তাকে লালন-পালন করা হোক।’

এমএইচএন/এআর/এমএআর/