কানাডায় স্ত্রী-ছেলেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫২ লাখ টাকা পাঠান মিজানুর রহমান

ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ পাচার করেছিলেন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কানাডায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এমন তথ্য মিলেছে। 

এরই মধ্যে কানাডায় পাচার করা প্রায় ৮০ হাজার কানাডিয়ান ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫২ লাখ টাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে এসেছে। দুদক সূত্র জানায়, কানাডায় পাচার করা অর্থ মিজানের স্ত্রী সোহেলিয়া, তার দুই ছেলে ফাহাদ রহমান অনিক ও আবরার ফাহিম রহমান অর্নবের ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত রয়েছে। এ বিষয়ে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা নিশ্চিত তথ্য পেয়েছেন।

ইতোমধ্যে কানাডার ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ ফিরে পেতে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স রিকোয়েস্ট) পাঠিয়েছে দুদক। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওই এমএলএআর পাঠানো হয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।

কানাডায় পাচার করা প্রায় ৮০ হাজার কানাডিয়ান ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫২ লাখ টাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে এসেছে। সেখানে পাচার করা অর্থ মিজানের স্ত্রী সোহেলিয়া, তার দুই ছেলে ফাহাদ রহমান অনিক ও আবরার ফাহিম রহমান অর্নবের ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত রয়েছে

অন্যদিকে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। যদিও ওই দুই দেশে পাচার করা অর্থের বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ প্রয়োজন। এ কারণে এ বিষয়ে এখনই মুখ খুলতে নারাজ দুদক। সংস্থাটির ধারণা, ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে ওই অর্থ পাচার করেছেন বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি মিজান। সেই উৎস খুঁজতে চলছে গোয়েন্দা কার্যক্রম।

দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মিজানুর রহমান

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (মহাপরিচালক) নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দুদক নিশ্চিত হয়েছে যে, কানাডায় মিজানুর রহমানের পরিবারের নামে অর্থ গচ্ছিত রয়েছে। যে কারণে কমিশন থেকে এমএলএআর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই এমএলএআর ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। দুদক এখন জবাবের অপেক্ষায় আছে।

কানাডায় মিজানুর রহমানের পরিবারের নামে অর্থ গচ্ছিত রয়েছে। যে কারণে কমিশন থেকে এমএলএআর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ওই এমএলএআর ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। দুদক এখন জবাবের অপেক্ষায়

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)

অন্যদিকে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করা অর্থের বিষয়ে আরও তদন্ত প্রয়োজন। যদি সুনির্দিষ্ট সব তথ্য-উপাত্ত মেলে, সেখানেও ভবিষ্যতে এমএলএআর পাঠানো হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন।

৪০ লাখ টাকা ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে চার্জশিট

৪০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান ও দুদক পরিচালক এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি চার্জশিট দাখিল করে দুদক। এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদক পরিচালক ও অনুসন্ধান দলের নেতা শেখ মো. ফানাফিল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। তিনি তদন্ত কাজ শেষ করে চার্জশিট দেন। যা এখন বিচারিকপর্যায়ে আছে বলে জানা গেছে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। যদিও ওই দুই দেশে পাচার করা অর্থের বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ প্রয়োজন। এ কারণে এ বিষয়ে এখনই মুখ খুলতে নারাজ দুদক

ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, খন্দকার এনামুল বাছির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কমিশনের দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ডিআইজি মিজানুর রহমানকে অবৈধ সুযোগ প্রদানের চেষ্টা করেছেন। বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় ৪০ লাখ টাকা উৎকোচ বা ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে ডিআইজি মিজান সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে নিজের বিরুদ্ধে আনিত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আশায় অর্থাৎ অনুসন্ধানের ফলাফল নিজের পক্ষে নেওয়ার উদ্দেশ্যে খন্দকার এনামুল বাছিরকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ প্রদান করেন। তদন্তপর্যায়ে বিশেষজ্ঞ মতামত, প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বক্তব্য, অডিও রেকর্ডের উভয়ের কথোপকথন ও অন্যান্য তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এসব অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৬১/১৬৫(ক)/১০৯ ধারা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৮৭ এর ৫(২) এবং মানিলন্ডারিং আইনের ৪(২) ও (৩) ধারায় মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

ঘটনার বিবরণে যা বলা হয়েছে

বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি মিজান ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি বাজারের ব্যাগে করে কিছু বইসহ ২৫ লাখ টাকা এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রমনা পার্কে উভয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এরপর তারা রমনা পার্ক থেকে একত্রে বের হয়ে ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকায় খন্দকার এনামুল বাছিরের কাছে ২৫ লাখ টাকার ব্যাগসহ হস্তান্তর করেন। কিছুদিন পর অর্থাৎ ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি একইভাবে মিজান একটি শপিং ব্যাগে করে ১৫ লাখ টাকা এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রমনা পার্কে আসেন। রমনা পার্কে আলোচনা শেষ করে উভয়ে পার্ক থেকে একত্রে বের হয়ে শান্তিনগর এলাকায় মিজানুর ১৫ লাখ টাকাসহ ব্যাগটি এনামুল বাছিরের কাছে হস্তান্তর করলে বাছির ব্যাগটি নিয়ে চলে যান।’

মিজানুর রহমান ও এনামুল বাছির

অনুসন্ধানপর্যায়ে ডিআইজি মিজান, তার দেহরক্ষী হৃদয় হাসান, গাড়িচালক সাদ্দাম হোসেনকে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই এবং তার অফিস আর্ডালি সুমনকে ২৬ জুন জিজ্ঞাসাবাদ করে সংস্থাটির টিম। ডিআইজি মিজানুর রহমান দুদকের তৎকালীন অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিচালক এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি মিডিয়ায় ফাঁস হওয়ার পরপর এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। যদিও পরিচালক এনামুল বারবার দাবি করেন যে রেকর্ড করা বক্তব্যগুলো কণ্ঠ নকল করে বানানো।

কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন

তিন কোটি সাত লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং তিন কোটি ২৮ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্ত্রী, ভাই ও ভাগনেসহ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলারও চার্জশিট দিয়েছে দুদক।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ পৌর শহরের আম্বিকাপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আকবরের দুই ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তৃতীয় মিজানুর রহমান। ১৯৮০ সালে মেহেন্দিগঞ্জের পাতারহাট পিএম স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন তিনি। ১৯৮২ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করেন।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মিজানের পুলিশ বিভাগে চাকরি হওয়ার পরই ভাগ্য খুলে যায় পুরো পরিবারের। দুই হাতে অর্থ কামিয়ে কয়েক বছর আগে মেহেন্দিগঞ্জ পৌর শহরের পাতারহাট-উলানিয়া সড়কের পাশে কালীকাপুর এলাকায় প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন বিশাল বাউন্ডারি ঘেরা বিলাসবহুল দোতালা বাড়ি ‘আমেনা ভিলা’। মেহেন্দিগঞ্জের লোকজনের কাছে ওই বাড়িটি ‘স্বর্ণকমল’ হিসেবে পরিচিত। 

বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের দুই ছেলেসহ স্ত্রী কানাডায় বসবাস করেন।

আরএম/এমএআর/