ফাইল ছবি

মহামারিতে ওলট-পালট বিশ্বে দেশে ফিরে আটকে পড়া প্রবাসীদের নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে পাশে দাঁড়াতে পল্লী জীবিকায়ন (তৃতীয় পর্যায়) শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সমবায় বিভাগ। তবে এর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরির আগে করা হয়নি কোনো সমীক্ষা। কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, প্রশিক্ষণ শেষে ঋণ প্রদান ও আদায়ের প্রক্রিয়া কী হবে সেটাও প্রকল্প প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়নি। যার কারণে, পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটিকে মনগড়া বলে আখ্যায়িত করেছে। 

বিশ্বজুড়ে মহামারি শুরুর পর দেশে ফিরে ওই সময়ে আটকা পড়েন বহু প্রবাসী। এছাড়া চাকরিচ্যুতও হতে হয়েছে অনেককে। মূলত তাদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছিল এই পল্লী জীবিকায়ন (তৃতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি। 

প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্যোক্তা ঋণ দেওয়ার কথাও বলা হয়। প্রকল্পটির ওপর ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ।  

পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এই প্রকল্প মনগড়া। ডিপিপি তৈরির আগে করা হয়নি কোনো সমীক্ষা। কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, প্রশিক্ষণের পর ঋণ প্রদান ও আদায়ের প্রক্রিয়া কী হবে সেটাও প্রকল্প প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়নি। ফলে প্রকল্পটির বিভিন্ন অংশের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে এসবের ব্যাখ্যা চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পল্লী জীবিকায়ন শীর্ষক তৃতীয় পর্যায়ের এ প্রকল্পটি ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রামের ৪৮টি জেলার ২২০টি উপজেলায় বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে- এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এতে কৃষি ও অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে। প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট দরিদ্র মহিলা ও পুরুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় সংগঠন সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা হবে। সংগঠিত উপকারভোগীদের সচেতনতা ও উপযুক্ত জীবিকায়নের মাধ্যমে আয়বর্ধন সক্ষমতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান করা হবে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে বিদেশ ফেরত কর্মহীন শ্রমিকদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ শেষে পুনর্বাসন করা হবে।

প্রকল্পটি সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে চলতি বছরের জুন থেকে ২০২৫ সাল নাগাদ বাস্তবায়ন হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। 

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৩০১ কোটি টাকা, কিন্তু কোনো ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়নি। নিয়ম অনুসারে ২৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এ প্রকল্পটির ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি।

প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ভুল-ত্রুটি থাকে, এটা স্বাভাবিক। তবে ভুল-ত্রুটি ধরার জন্য তো পরিকল্পনা কমিশন আছে। তারপরও ডিপিপিতে ভুল-ত্রুটি কমিয়ে আনতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে যত্নবান হতে হবে

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান

প্রকল্পের ডিপিপিতে বলা হয়েছে, ৩ লাখ ৩ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশিক্ষণের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ নেই। প্রশিক্ষণগুলো কিভাবে আয়োজন করা হবে তার বিস্তারিতও উল্লেখ নেই। প্রকল্পের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯০০ জনকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এসব উদ্যোক্তাকে নির্বাচন করার প্রক্রিয়া এবং ৭ লাখ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করার বিষয়টি ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোন শ্রেণির মানুষকে উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচন করা হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই।

কোভিড-১৯ এর কারণে বিদেশ ফেরত কর্মহীন শ্রমিকদের কর্মমুখি প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ পরবর্তী ক্ষুদ্র ও উদ্যেক্তা ঋণ দেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ডিপিপিতে। কিন্তু কতজনকে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং কিভাবে ঋণ দেওয়া হবে তার মডিউল ডিপিপিতে নেই।

প্রকল্পের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ক্ষুদ্র ঋণ বাবদ ৩৮৭ কোটি টাকা এবং উদ্যেক্তা ঋণ বাবদ ৫০০ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ খাতের ঋণ প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট বিভাজন থাকা প্রয়োজন। প্রকল্পের ঋণ অর্থ পরিচালনা কিভাবে ও কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হবে তারও উল্লেখ নেই। প্রশিক্ষণ খাতে ১৭৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, কিন্তু প্রশিক্ষণের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংযোজন করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর আগে প্রকল্প তদারকি সংস্থা আইএমইডি পল্লী জীবিকায়ন (২য় পর্যায়) প্রকল্পের ওপর নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষায় ১ লাখ সুফলভোগীর জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ এবং ৫০ হাজার সুফলভোগীর জন্য উদ্যোক্তা ঋণ চালু করা ও প্রয়োজনীয় তহবিলের সংস্থান রাখার সুপারিশ করে। তাদের প্রতিবেদনে, সরকারি প্রকল্প অনুযায়ী সুদের হারের পরিমাণ ৬ থেকে ৭ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন হবে।

প্রকল্পের ডিপিপিতে অনেক গ্যাপ ছিল। পিইসি সভায় সমীক্ষাসহ ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করার জন্য বলা হয়েছে। ডিপিপি সংশোধন করে আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদ্য সাবেক সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ

এ প্রসঙ্গে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) উপপরিচালক (পরিকল্পনা) জিয়াউল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রকল্পটির ওপর পিইসি সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশন। পিইসি সভার কার্যপত্র এখনও আমাদের কাছে আসেনি। পিইসি সভার কার্যপত্র পেলে পরিকল্পনা কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বাইরে আর কিছু বলতে পারবো না।’

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম প্রধান রবীন্দ্রনাথ বর্মন বলেন, প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছু অসংগতি রয়েছে। পিইসি সভায় এগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যা পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদ্য সাবেক সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভায় ব্যয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। ১৩শ কোটি টাকা থেকে ব্যয় কমিয়ে ৮৫০ কোটি টাকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫০ কোটি টাকা উদ্যোক্তাদের ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হবে।

তিনি বলেন, বিআরডিবির কার্যক্রম নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে সেরকম অগ্রগতি হয়নি। কারণ, এখানে দক্ষ লোকের অভাব রয়েছে। ২০১৪ সালের পর থেকে এ দফতরে কোনো ডিজিই (মহাপরিচালক) দীর্ঘকালীন থাকতে পারেননি। বিআরডিবির সক্ষমতা বাড়াতে এখানকার কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার আন্দোলনও করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ঋণ দেওয়া আর ঋণ তোলাই একমাত্র কাজ। বিভিন্ন জটিলতার কারণে সংস্থাটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না।

জাকির হোসেন আকন্দ আরও বলেন, বর্তমান ডিজির চাকরির মেয়াদ আরও কয়েক বছর আছে এবং উনি সৃজনশীল মানুষ। ফলে এ বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে ডিজির আন্তরিকতার ঘাটতি থাকবে না। বিআরডিবির গাইডলাইন অনুযায়ী তারা একজন গ্রাহককে ২৫ হাজার টাকা ঋণ দিতে পারতো। সত্য কথা বলতে ২৫ হাজার টাকা ঋণে কোনো উদ্যোক্তা তৈরি করা যায় না। এজন্য পিইসি সভায় ডিজিকে বলেছি, একজন উদ্যোক্তাকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ দিতে হবে এবং বিদেশ ফেরতদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তিনি জানান, প্রকল্পের ডিপিপিতে অনেক গ্যাপ ছিল। পিইসি সভায় সমীক্ষাসহ ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করার জন্য বলা হয়েছে। ডিপিপি সংশোধন করে আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে।  

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং সে অনুযায়ীই কাজ করা হচ্ছে। যদিও করোনা সবকিছুকেই পিছিয়ে দিয়েছে। তারপরও সময়ের সাথে সাথে সবার আপডেট থাকতে হবে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ভুল-ত্রুটি থাকে, এটা স্বাভাবিক। তবে ভুল-ত্রুটি ধরার জন্য তো পরিকল্পনা কমিশন আছে। তারপরও ডিপিপিতে ভুল-ত্রুটি কমিয়ে আনতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে যত্নবান হতে হবে। বিআরডিবির বিষয়ে তিনি জানান, সংস্থাটি যে ব্যাপকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে সেভাবে ব্যাপকতা ধরে রাখতে পারেনি সরকারি বিভাগটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিআরডিবির সক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করছি।

এসআর/এনএফ