শুল্ক অনেক বেশি হওয়ায় বৈধ পথে আমদানি কমে যাচ্ছে অ্যালকোহল-জাতীয় পণ্যের

লাইসেন্স ছাড়া মদ কেনা, বহন বা সংরক্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তা সত্ত্বেও অনেক মানুষ নিয়মিত অ্যালকোহল-জাতীয় মাদক গ্রহণ করেন। দিনদিন এ চাহিদা বেড়েছে বলে সবার ধারণা। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান বলছে, অ্যালকোহল-জাতীয় পণ্যের আমদানি দিনদিন কমছে। তার মানে কি দেশে মদ্যপায়ীর সংখ্যা কমছে? বিষয়টি ‘সুখবর’ মনে হলেও কারণ কিন্তু ভিন্ন!

২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মাদকের প্রকার অনুসারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গাঁজা, ৮২ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে অ্যালকোহল, ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। ইয়াবা ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ, অপিয়ড ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের ওষুধ ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ।

অন্যদিকে, চলতি বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি মানুষ মাদকাসক্ত। অ্যালকোহল গ্রহণকারীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বন্ড সুবিধা কিংবা এর বাইরে অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় আমদানির পরিমাণ দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে পাওয়া চার বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অ্যালকোহল আমদানির পরিমাণ কমেছে ২০ থেকে ৫৫ শতাংশ।

দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মাদকের প্রকার অনুসারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গাঁজা, ৮২ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে অ্যালকোহল, ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। ইয়াবা ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ, অপিয়ড ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের ওষুধ ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ

এক হিসাবে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ড সুবিধা ও বন্ডের বাইরে মদ বা অ্যালকোহল-জাতীয় পণ্যের আমদানি গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় এ পণ্যের আমদানি কমেছে ৫৫ শতাংশের বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় মদ-জাতীয় পণ্যের মোট আমদানি কমেছে ২৭৪০ টন।

আমদানি কমলেও মনে করা হচ্ছে অ্যালকোহল গ্রহণকারীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে

তবে কি করোনা মহামারির প্রভাব মদ-জাতীয় পণ্যের আসক্তি কমিয়েছে, নাকি যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ জাতীয় পানীয়র শুল্ক অনেক বেশি হওয়ায় বৈধ পথে আমদানি কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বিয়ার ও ওয়াইন আমদানিতে ৪৫০ শতাংশ কর দিতে হয়। হুইস্কি বা ভদকার মতো পানীয় আমদানিতে শুল্কের হার ৬০০ শতাংশের বেশি।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মানুষ এখন বিকল্প পথে মদ-জাতীয় পানীয় সংগ্রহ করছে কিংবা অন্যকোনো নেশায় আসক্ত হচ্ছে। প্রসার ঘটেছে মদের অনলাইন ব্যবসাও। যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই।

এ বিষয়ে কাস্টমস বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে সারাদেশে ১৪১টি লাইসেন্স করা মদের বার রয়েছে। যার ৮০ শতাংশ রাজধানীতে। এছাড়া বন্ড সুবিধায় আসা মদ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বরা (প্রিভিলেজড পার্সন) বেশি কেনেন। আমাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে তথ্য এসেছে, তারা ওই মদের একটি অংশ বাইরে বিক্রি করে দেন। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি, চোরাইপথেও মদ আসে।

এনবিআরের কাস্টমস ও গোয়েন্দা বিভাগের অভিযানে কয়েকটি বড় চালান আটকও হয়েছে। তবে মদের আমদানি কমে যাওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশিদের আসা-যাওয়া অনেকটা কমে গেছে। অধিকাংশ বারগুলো বন্ধ রয়েছে। এছাড়া কৃত্রিম সংকটও হতে পারে। লাইসেন্স করা ব্যবসায়ীরা চান মদ আমদানি ওপেন করে দেওয়া হোক। যে কারণে তারা চোরাই মদ বা ভেজাল মদের মৃত্যুর বিষয়টি বেশি বেশি প্রচার করতে চান। এর সঙ্গে অনলাইনে মদের ব্যবসার প্রসারও একটি বড় কারণ—মনে করেন ওই কর্মকর্তা।

করোনা মহামারির প্রভাব মদ-জাতীয় পণ্যের আসক্তি কমিয়েছে, নাকি যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ জাতীয় পানীয়র শুল্ক অনেক বেশি হওয়ায় বৈধ পথে আমদানি কমে যাচ্ছে

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা ও বারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে বিভিন্ন ওয়্যারহাউজ বা ক্লাব থেকে অনেকে কম দামে মদ কিনতেন। কিন্তু সম্প্রতি শুল্ক বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের ফলে ওয়্যারহাউজ বা ক্লাব থেকে বিদেশি নাগরিক ছাড়া মদ বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যারা বিদেশি মদপানে অভ্যস্ত তারা এখন বিভিন্ন সূত্র থেকে মদ কেনার চেষ্টা করছেন। গত দুই মাস ধরে ঢাকার অনেক বারে বিদেশি মদ একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব বারে বিক্রি হয়, সেখানেও দাম কয়েকগুণ বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন দেশীয় মদও পাওয়া যায়।

আমদানি কমে যাওয়ায় বিদেশি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি দেশীয় মদও স্থান পাচ্ছে বারগুলোতে

বন্ড সুবিধায় দেশে ছয় ধরনের মদ বা অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় বাংলাদেশে আসে। আমদানি করা মদের মধ্যে রয়েছে- বিয়ার, স্পিরিট জাতীয় পানীয়, হুইস্কি, রাম ও টাফিয়া, গিন ও জেনিভা, ভদকা, লিকার’স ও করডিয়ালস। বন্ডের আওতায় ছয়টি লাইসেন্স রয়েছে। প্রত্যেকটি বন্ডের এক ইন্সপেক্টর থাকেন পর্যবেক্ষণে।

এনবিআর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ড সুবিধা ও বন্ডের বাইরে মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই হাজার ৭৯ টন ৪৮৩ কেজি মদ (২০ লাখ ৭৯ হাজার ৪৮৩ কেজি) বন্ড সুবিধায় আমদানি হয়েছে। যেখানে ওই অর্থবছরে বন্ড সুবিধার বাইরে ১৪০ টন ৫৭৬ কেজি মদ (এক লাখ ৪০ হাজার ৫৭৬ কেজি) আমদানি হয়। বন্ড সুবিধা ও বন্ড সুবিধার বাইরে আমদানি করা মোট অ্যালকোহল-জাতীয় পণ্যের পরিমাণ দুই হাজার ২২০ টন ৫৯ কেজি। যা তার আগের অর্থবছরের তুলনায় আমদানি কমেছে দুই হাজার ৭৪০ টন ২৬৬ কেজি বা ৫৫.২৪ শতাংশ।

এর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) চার হাজার ৭৭৫ টন ২০৯ কেজি মদ (৪৭ লাখ ৭৫ হাজার ২০৯ কেজি) আমদানি হয় বন্ড সুবিধায়। বন্ডের বাইরে আমদানির পরিমাণ ১৮৫ টন ১১৬ কেজি মদ (এক লাখ ৮৫ হাজার ১১৬ কেজি)। ওই বছর মোট আমদানি করা মদ বা সমজাতীয় পণ্যের পরিমাণ চার হাজার ৯৬০ টন ৩২৫ কেজি।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ড সুবিধা ও বন্ডের বাইরে মদ বা অ্যালকোহল-জাতীয় পণ্যের আমদানি গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় এ পণ্যের আমদানি কমেছে ৫৫ শতাংশের বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় মদ-জাতীয় পণ্যের মোট আমদানি কমেছে ২৭৪০ টন

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বন্ড সুবিধায় দেশে আমদানি হয় চার হাজার ২৫৮ টন ৬০ কেজি মদ (৪২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০ কেজি)। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২১২ টন ৩২৫ কেজি (দুই লাখ ১২ হাজার ৩২৫ কেজি) মদ আমদানি হয়।

এনবিআর বলছে, আইন অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম চলমান থাকবে

এনবিআরের অধীন কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় থাকা ছয়টি বারে মদের আমদানি ও সরবরাহ দেখভাল করে। এগুলো হলো- সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড, ইস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসেস, টস বন্ড, ন্যাশনাল ওয়্যারহাউজ, ঢাকা ওয়্যারহাউজ ও এইচ কবির অ্যান্ড কোম্পানি। এর মধ্যে পাঁচটি গুলশানে এবং একটি মহাখালীতে অবস্থিত। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রিভিলেজড পার্সনদের শুল্কমুক্ত সুবিধার সনদ দিয়ে থাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আইন অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম চলমান থাকবে

মো. শওকাত হোসেন, কমিশনার, ঢাকা কাস্টমস

অভিযোগ রয়েছে, অতীতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধাপ্রাপ্ত বারগুলো বিপুল পরিমাণ শুল্কমুক্ত মদ এনে বাইরে বিক্রি করে দিত। এতে বারগুলো লাভবান হলেও সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাত। এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে ২০১৭ সালে ছয়টি বন্ডেড ওয়্যারহাউজে মদ আমদানি, তা বিক্রির পাস বই সংরক্ষণ; ক্রেতার শুল্কমুক্ত সুবিধার সনদ দেখানো এবং কোন ব্র্যান্ডের কতটুকু বিক্রি হলো তা প্রতি মাসে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। তবে শুরুর দিকে তা পরিপালন না হলেও সম্প্রতি এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যায় এনবিআর। আদেশটি সঠিকভাবে পরিপালনের জন্য এনবিআর থেকে সংশ্লিষ্ট ছয়টি বারসহ দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, একজন প্রিভিলেজড পার্সন বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ শুল্কমুক্ত সুবিধায় গ্রহণ করতে পারেন। এখন প্রতিটি বিক্রির বিপরীতে পাস বইয়ের কপি ও শুল্কমুক্ত সুবিধার কপি জমা নেওয়া হচ্ছে প্রতি মাসে। ফলে অনিয়ম করে বাড়তি আমদানির সুযোগ কমে গেছে। 

এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার মো. শওকাত হোসেন বলেন, আইন অনুযায়ী আমাদের কার্যক্রম চলমান থাকবে।

অন্যদিকে, এনবিআরের অধীন ভ্যাট গোয়েন্দা বিভাগ রাজধানীজুড়ে অভিযান চালিয়ে গত কয়েক মাসে বেশকিছু মদের বার থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ মদ উদ্ধার করে। এতে অন্য বারগুলোও সতর্ক হয়ে যায়। এছাড়া করোনার কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিমান যোগাযোগ কমে যায়। পরে বিমানবন্দরগুলো খুলে দিলেও আরোপিত হয় কড়াকড়ি। ফলে সার্বিকভাবে কমে গেছে অ্যালকোহল-জাতীয় মাদকের আমদানি।

আরএম/এমএআর/