কেউ গরুর রচনা জমা দিলে সেটি ছাপা হয়ে যাবে? লেখা ছাপার সঙ্গে রিভিউয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ডিন অফিস ও সম্পাদনা পরিষদ জড়িত। কিন্তু এখানে এককভাবে জোর করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে...

সামিয়া রহমান, জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদাবনতি করা হয়েছে। এরপর থেকে গণমাধ্যম, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাকে নিয়ে চলছে সরগরম আলোচনা। সামিয়া রহমানও একাধিক বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্ত ‘ষড়যন্ত্র’ বলে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার নিজ বাসায় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় খোলাসা করেন কীভাবে তিনি এ ষড়যন্ত্রের শিকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নূর মোহাম্মদ। আজ থাকছে এর শেষ পর্ব। 

ঢাকা পোস্ট : আপনি বলছেন, যে লেখাটি ছাপা হয়েছে সেটি আপনার নয়। আসলে কী হয়েছিল…

সামিয়া রহমান : ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আমার ভগ্নিপতি মারা যাচ্ছেন— এমন খবর পেয়ে শর্ট টাইমের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দেই। বিমানবন্দরে ডিন অফিস থেকে আমার কাছে প্রথম ফোন আসে। আমাকে বলা হয়, আপনি ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান যৌথভাবে যে লেখাটি জমা দিয়েছেন সেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি শোনার পর আমি খুব অবাক হলাম। কারণ, আমি সাম্প্রতিক সময়ে ডিন অফিসে কোনো লেখা জমা দেইনি।

কিন্তু মারজান অসম্পূর্ণ একটি লেখা আমাকে না জানিয়ে ডিন অফিসে জমা দেয়। সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি এবং আমাকেও বিষয়টি জানায়নি। আমি স্বীকার করছি, আমার দায়িত্ব ছিল কী লেখা হচ্ছে বা কী যাচ্ছে, ওই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া। কিন্তু সে (মারজান) যে ডিন অফিসে আমার অনুমোদন ছাড়া লেখাটি পাঠিয়ে দিয়েছে, বিষয়টি আমি জানতাম না

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

সঙ্গে সঙ্গে আমি মারজানকে ফোন দিয়ে জানতে চাই, কোন লেখার কথা বলছে ডিন অফিস। মারজান তখন বলে, ম্যাডাম আপনি যে আইডিয়া দিয়েছিলেন সেটি। তখনই জানতে পারলাম মারজান আমার আইডিয়ার লেখাটি সংশোধন, বিয়োজন করে নিজের ভাষায় লিখে রেফারেন্সসহ ডিন অফিসে জমা দিয়েছে এবং সেটি ডিন অফিস গ্রহণও করেছে।

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

আমি তাকে বারবার প্রশ্ন করেছিলাম, লেখার বিশ্লেষণ ঠিকমতো করেছ কিনা, রেফারেন্স ঠিকমতো দিয়েছ কিনা। সে দায়িত্ব নিয়ে বলেছে, ম্যাডাম আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন, সব ঠিকভাবে হয়েছে।

আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমাকে না দেখিয়ে সে ডিন অফিসে লেখাটি কেন জমা দিয়েছে। আর রিভিউয়ারের কপি আমাকে পাঠাল না কেন? সে শুধু আমাকে ‘স্যরি’ বলেছে।

আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরও মারজানকে ডিন অফিসে যোগাযোগ করতে বলি এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত লেখাটি না ছাপানোর জন্য বলি।

মারজান তখন বলে, সব লেখা ও রিভিউয়ারের কপি তার কাছে আছে। সে ডিন অফিসে পাঠিয়ে দেবে। আমি জানি না, আসলে সে ভুল কপি পাঠিয়েছে কিনা, নাকি কোথাও কোনো ভুল হয়েছে কিনা?

লেখা ছাপা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেহেতু আমি জড়িত ছিলাম না, তাই দেরি না করে সেটা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাই ডিন স্যারকে। আমি ওই সময় লেখা প্রত্যাহারের আবেদন করি, সেই স্বাক্ষরযুক্ত চিঠিও আছে আমার কাছে

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

ঢাকা পোস্ট : তারপরও লেখা ছাপা হলো কীভাবে?

সামিয়া রহমান : লেখা ছাপা হয়েছে এটা আমি প্রথম জানতে পারি ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডিন ফরিদউদ্দীন স্যার আমাকে ফোনে জানান, তোমার যে লেখাটি ছাপা হয়েছে, এ লেখায় তুমি প্লেজারিজম (চৌর্যবৃত্তি ) করেছ— এমন অভিযোগ করেছেন তোমার বিভাগের দুজন শিক্ষক। তারা তোমার শাস্তি চান। তখনই আমি ফরিদ স্যারের কাছে জানতে চাই, কোন লেখাটি। তখন তিনি তার অফিসে আমাকে ডেকে লেখা ও অভিযোগের বিষয়টি জানান।

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক; সঙ্গে ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নূর মোহাম্মদ

ঢাকা পোস্ট : আপনার নামে অন্য একজন লেখা জমা দিল কীভাবে?

সামিয়া রহমান : মারজান আমার প্রাক্তন ছাত্র। পরবর্তীতে সে অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়। তাকে আমি একটি টেলিভিশনে চাকরি দিয়েছিলাম। সে বলতো, ম্যাডাম আপনার সঙ্গে আমি কিছু কাজ করতে চাই। তখন বিভিন্ন জার্নালে আমার সঙ্গে তার কিছু গবেষণামূলক লেখা ছাপা হয়।

যে লেখাটি নিয়ে বিতর্ক সেটির মূল ড্রাফট ২০১৫ সালের শুরুর দিকে। আমরা যখন গবেষণা করি তখন সাধারণত দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেই। আমি মূল আইডিয়া আমার কো-অথর মারজানকে দিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিজের ভাষায় বিশ্লেষণ করে এর ওপর আলোচনা-গবেষণা করে যথাযথভাবে সহায়ক তথ্য সংযোজন করে আমাকে পাঠাতে বলি। একসময় আমি বিষয়টি ভুলেও যাই।

আমি তৎকালীন ডিনকে বলেছিলাম, লেখাটি আমি প্রত্যাহার করতে চাই। কিন্তু তিনি সে সুযোগ দেননি। ডিন তখন বলেছিলেন, আমাকে একদিনের নোটিশে ভিসি আরেফিন সিদ্দিক ডিন থেকে সরিয়ে দেয়। আমি এর প্রতিশোধ নেব

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

কিন্তু মারজান অসম্পূর্ণ একটি লেখা আমাকে না জানিয়ে ডিন অফিসে জমা দেয়। সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেনি এবং আমাকেও বিষয়টি জানায়নি। আমি স্বীকার করছি, আমার দায়িত্ব ছিল কী লেখা হচ্ছে বা কী যাচ্ছে, ওই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া। কিন্তু সে (মারজান) যে ডিন অফিসে আমার অনুমোদন ছাড়া লেখাটি পাঠিয়ে দিয়েছে, বিষয়টি আমি জানতাম না।

ঢাকা পোস্ট : লেখাটি প্রত্যাহার করলেন না কেন?

সামিয়া রহমান : লেখা ছাপা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেহেতু আমি জড়িত ছিলাম না, তাই দেরি না করে সেটা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানাই ডিন স্যারকে। আমি ওই সময় লেখা প্রত্যাহারের আবেদন করি, সেই স্বাক্ষরযুক্ত চিঠিও আছে আমার কাছে।

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

তৎকালীন উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারকে বিষয়টি অবহিত করলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিন্ডিকেটে বিষয়টি তুলতে বলেন। কিন্তু ড. ফরিদউদ্দীন বিষয়টি জিইয়ে রাখেন সময় ও সুযোগের জন্য। সাত মাস ধামাচাপা দিয়ে রাখার পর ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আরেফিন স্যার উপাচার্যের চেয়ার থেকে সরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ভুয়া চিঠিটি তৈরি করা হয় শিকাগো জার্নালের নামে, অ্যালেক্স মার্টিনের পরিচয় দিয়ে। যেখানে অ্যালেক্স মার্টিন বলে কারও অস্তিত্ব নেই এবং চিঠিটিও শিকাগো জার্নাল থেকে পাঠানো হয়নি।

যখন উপাচার্য পরিবর্তন হলো তখন সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলো। আমি বহুবার বলার পরও সেটি সিন্ডিকেটে ওঠেনি। ছয় মাস পর কেন তোলা হলো? শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাটি যাবার কথা নয়, ঈর্ষান্বিত হয়ে বা প্রতিহিংসাবশত কেউ সেটি পাঠিয়েছে

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

আমি তৎকালীন ডিনকে বলেছিলাম, লেখাটি আমি প্রত্যাহার করতে চাই। কিন্তু তিনি সে সুযোগ দেননি। ডিন তখন বলেছিলেন, আমাকে একদিনের নোটিশে ভিসি আরেফিন সিদ্দিক ডিন থেকে সরিয়ে দেয়। আমি এর প্রতিশোধ নেব।

ঢাকা পোস্ট : লেখা আপনার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে দায়ী? যদি একটু বলতেন…

সামিয়া রহমান : কোনো লেখকের লেখা রিভিউয়ারের কাছে যাওয়ার পর তিনি সহায়ক তথ্যের ঘাটতির বিষয়ে লেখাটির দুর্বলতা আছে বলে রিজেক্ট (প্রত্যাখ্যান) করতে পারেন অথবা কারেকশন (সংশোধনী) দিতে পারেন। কিন্তু এ লেখার ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়নি। যদি তিনি করতেন, তাহলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

তারপরও আমি জার্নাল থেকে লেখাটি সরিয়ে ফেলার জন্য ডিন অফিসকে লিখিত অনুরোধ করি। তৎকালীন উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক স্যারকে লেখাটি দেখানো হলে তিনি এটা প্লেজারিজম না, সাইটেশন (উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার) হয়েছে বলে জানান। এটার দেখার দায়িত্ব রিভিউয়ারের। আমি ডিনকে বিষয়টি সিন্ডিকেটে ওঠানোর জন্য বলি। যখন উপাচার্য পরিবর্তন হলো তখন সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলো। আমি বহুবার বলার পরও সেটি সিন্ডিকেটে ওঠেনি। ছয় মাস পর কেন তোলা হলো? শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাটি যাবার কথা নয়, ঈর্ষান্বিত হয়ে বা প্রতিহিংসাবশত কেউ সেটি পাঠিয়েছে।

আমি শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করার পর তারা জানিয়েছে, অ্যালেক্স মার্টিন বলে কেউ নেই এবং তারা এ ধরনের চিঠি পাঠায়নি। শিকাগো জার্নালের এডিটর নিজেই এটি স্বীকার করেছেন। তাই পুরো ঘটনাটি মিথ্যা। আমাকে ফাঁসানোর জন্য ভুয়া চিঠিটি তৈরি করা হয়

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

ঢাকা পোস্ট : আপনি বলতে চাচ্ছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠিটি মিথ্যা…

সামিয়া রহমান : আমার লেখায় প্লেজারিজমের মূল দলিল হিসেবে তদন্ত কমিটি শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যালেক্স মার্টিন পরিচয় দিয়ে যে চিঠিটি আমলে নিয়েছে সেটিও পুরোপুরি মিথ্যা। এমন একটি দলিল আমার হাতে রয়েছে। আমি শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করার পর তারা জানিয়েছে, অ্যালেক্স মার্টিন বলে কেউ নেই এবং তারা এ ধরনের চিঠি পাঠায়নি। শিকাগো জার্নালের এডিটর নিজেই এটি স্বীকার করেছেন। তাই পুরো ঘটনাটি মিথ্যা। আমাকে ফাঁসানোর জন্য ভুয়া চিঠিটি তৈরি করা হয়।

সামিয়া রহমানের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নূর মোহাম্মদ

ঢাকা পোস্ট : লেখাটি নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তা-ই মনে করেন…

সামিয়া রহমান : লেখাটি ছাপানোর প্রক্রিয়া ভুল ছিল। সেটি ট্রাইব্যুনাল ও প্রাক্তন উপাচার্য বলেছেন। আমি দালিলিকভাবে প্রমাণ করতে পারব ছাপা হওয়ার প্রতিটি স্তরে কীভাবে ভুল হয়েছে। একজন একটি লেখা জমা দেওয়ার পর তা রিভিউয়ারের কাছে যায়। তিনি কারেকশন (সংশোধনী) দিয়ে লেখককে পাঠান। সেটি সংশোধনের পর সম্পাদনা পরিষদ দেখে ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পর সেই লেখা ছাপা হয়। কিন্তু এ লেখার অসংগতিগুলো রিভিউয়ার, সম্পাদনা পরিষদ দেখেনি। তার মানে, কেউ গরুর রচনা জমা দিলে সেটি ছাপা হয়ে যাবে? লেখা ছাপার সঙ্গে রিভিউয়ার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ডিন অফিস ও সম্পাদনা পরিষদ জড়িত। কিন্তু এখানে এককভাবে জোর করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে। 

তদন্ত কমিটি নিরপেক্ষভাবে কাজ করেনি। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও তারা দুই বছর দীর্ঘায়িত করেছে শুধু সময়ের অপেক্ষা আর মিডিয়া ট্রায়ালের জন্য

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

ঢাকা পোস্ট : কারা মিডিয়া ট্রায়াল করেছে?

সামিয়া রহমান : বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন। ২০১৭ সালে আমি ডিন স্যারকে বারবার বলেছি, আমার ইস্যুটি সিন্ডিকেটে তুলে তা সুরাহা করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটি জিইয়ে রেখেছেন সময় ও সুযোগের অপেক্ষার জন্য। যখন আরেফিন স্যার উপাচার্য চেয়ার থেকে সরে গেলেন, তখনই এটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলো।

আমার বিরুদ্ধে যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল তারা শুরু থেকেই মিডিয়া ট্রায়াল শুরু করে। তদন্ত কমিটি নিরপেক্ষভাবে কাজ করেনি। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও তারা দুই বছর দীর্ঘায়িত করেছে শুধু সময়ের অপেক্ষা আর মিডিয়া ট্রায়ালের জন্য।

এছাড়া কমিটির কার্যক্রম গোপনীয় হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো সদস্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে প্রতিটি মিটিং শেষে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা, ভুয়া ও উস্কানিমূলক তথ্য সরবরাহ করতেন। তদন্ত কমিটি দুই বছরের অধিক সময় তদন্ত করে মূলত মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে আমাকে দোষী করার চেষ্টা করেছে। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটির দুজন সদস্যের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চিঠি দেই। কিন্তু সেই চিঠিও আমলে নেওয়া হয়নি।

একটা লেখা কেউ চাইলে যেমন খুশি ছাপাতে পারেন না। অনেকগুলো ধাপ আছে, প্রক্রিয়াও আছে। এ ধাপে যারা ছিলেন তারা কেউ তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। তাই লেখকদের দায়ী করলে সমানভাবে রিভিউয়ার এবং সম্পাদনা পরিষদকে এর দায়ভার নিতে হবে

সামিয়া রহমান, সাংবাদিক, উপস্থাপক ও শিক্ষক

ঢাকা পোস্ট : আপনি ষড়যন্ত্রের শিকার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তা জানিয়েছিলেন কি?

সামিয়া রহমান : পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আমি তৎকালীন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, তৎকালীন উপ-উপাচার্য, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানসহ প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমি বলেছি, লেখার আইডিয়া আমার। কিন্তু পরবর্তীতে তা জার্নালে ছাপা থেকে কোনো প্রক্রিয়ায় আমি যুক্ত ছিলাম না। প্রতিটি বিষয়ের প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট আমি জমা দিয়েছি।

উপ-উপাচার্যকে চিঠিতে আমি জানিয়েছি, লেখক ও রিভিউয়ারের সংশোধনসহ পুরো প্রক্রিয়া দেখার দায়িত্ব সম্পাদনা পরিষদের। গত আট বছরে সম্পাদনা পরিষদের কোনো মিটিং হয়নি। তিনি (উপ-উপাচার্য) কোনোকিছুই আমলে নেননি। তদন্তে আমার বক্তব্য শোনা হয়নি, বরং একচেটিয়া তারা বলে গেছেন।

একটা লেখা কেউ চাইলে যেমন খুশি ছাপাতে পারেন না। অনেকগুলো ধাপ আছে, প্রক্রিয়াও আছে। এ ধাপে যারা ছিলেন তারা কেউ তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। তাই লেখকদের দায়ী করলে সমানভাবে রিভিউয়ার এবং সম্পাদনা পরিষদকে এর দায়ভার নিতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : আর কাউকে দোষারোপ করছেন?

সামিয়া রহমান : এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমার সাবেক আইনজীবীও জড়িত। কিন্তু অনেক পরে আমি এটা বুঝেছি। তিনি আমাকে প্রতিনিয়ত মিসগাইড করেছেন। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে মুভমেন্ট করতে চেয়েছি, তখনই তিনি বলেছেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কথা বলা যাবে না। আমি একটি পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু তিনি তা করতে দেননি। অভিযোগ, তদন্ত… এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নানা হুমকি-ধমকানি আমাকে শুনতে হয়েছে। সিন্ডিকেটে ন্যায়বিচার পাব— এ আশায় এতদিন আমি চুপ ছিলাম।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ‘রিভিউ’ জার্নালে সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের যৌথ আট পৃষ্ঠার নিবন্ধন ‘এ নিউ ডাইমেনশন অব কলোনিয়ালিজম অ্যান্ড পপ কালচার : এ কেস স্টাডি অব দ্য কালচারাল ইমপেরিয়ালিজম’ প্রকাশিত হয়। অভিযোগ ওঠে, ১৯৮২ সালের শিকাগো ইউনিভার্সিটির জার্নাল ‘ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি’-তে প্রকাশিত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ নামের একটি নিবন্ধ থেকে প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠা হুবহু নকল করা হয়েছে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এক লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ওই চুরির কথা জানায় ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস। শুধু মিশেল ফুকোই নন, বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম' গ্রন্থের পাতার পর পাতাও সামিয়া ও মারজান হুবহু নকল করেন বলে অভিযোগ ওঠে।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরিন আহমেদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালে কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সামিয়া-মারজানের চৌর্যবৃত্তির অভিযোগটির সত্যতা মিলেছে। তবে কমিটি কোনো শাস্তির সুপারিশ করেনি।

সামিয়া-মারজানের শাস্তি নির্ধারণের জন্য গত বছরের অক্টোবরে সিন্ডিকেট সভায় আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল ইনক্রিমেন্ট কাটার মতো ‘লঘু শাস্তির’ সুপারিশ করলেও সিন্ডিকেট তা নাকচ করে দিয়ে তাদের পদাবনতি করেন।

এনএম/এমএআর/