• ৪৮ বিজয়ীর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ২৬
• বিদ্রোহী প্রার্থী ৭, জাতীয় পার্টির ২, স্বতন্ত্র ২ ও স্থগিত ২ জেলা
• ৯২টি উপজেলায় কম ভোট পেয়েছেন দলীয় প্রার্থী
• এমপি ও মন্ত্রীরাও নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন

জেলা পরিষদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে লড়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। এমনকি অনেক স্থানে স্বয়ং জনপ্রতিনিধিদের ভোটেই পরাজয় ঘটেছে নৌকার। এছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে যারা নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে সেই নৌকাকেই ডুবিয়েছেন তারা!

এই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ। তবে, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন নির্বাচনে যারা নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের ক্ষমা করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

গত ১৭ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। তবে, এই নির্বাচনের ভোটার সাধারণ মানুষ নন, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিরা দিয়েছিলেন ভোট। 

নৌকা প্রতীকে নির্বাচন না হলেও এবারের জেলা পরিষদ ভোটে আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল। দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থীকে চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ফলে দলটি প্রার্থীও ঘোষণা করেনি।

এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার পর ক্ষমতাসীন দলের কিছু দুর্বলতা উঠে এসেছে। একইসঙ্গে সামনে এসেছে তৃণমূলের অনেক সমস্যাও। অনেক জেলায় পরাজিত হয়েছেন নৌকার সমর্থিত প্রার্থী। আবার বিজয়ী হয়েছেন অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীও। জেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ খুঁজছেন ক্ষমতাসীনরা। জয়-পরাজয় কিংবা কম ভোট পাওয়ার পেছনের রহস্য দলীয় হাইকমান্ডকে জানাতেও বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাত প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। এর কারণগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে দল। আবার এই নির্বাচনের কারণে অনেক জায়গায় বিরোধ প্রকাশ পেয়েছে। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনেক উপজেলায় নৌকা সমর্থিত প্রার্থীদের নিজ জনপ্রতিনিধিরাই ভোট দেয়নি। কেন দেয়নি, কারণ কী, কারও ইন্ধন আছে কি না— তাও খতিয়ে দেখছেন ক্ষমতাসীনরা।

এদিকে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে যারা বিদ্রোহী ও দলের নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছিল এবং ক্ষমা চেয়ে আবেদন করেছিল তাদের ক্ষমা করেছেন দলের হাইকমান্ড। ক্ষমা পেলেও বিদ্রোহীরা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে পারবে না বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, বেশ কয়েকটি জেলার নির্বাচন আমরা দেখেছি। সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমপি কিংবা মন্ত্রীদের গ্রুপিং বেশি। এমনকি মন্ত্রীরাও নিজ জেলায় নিজস্ব বলয় তৈরি করতে ‘মাই ম্যান’ দিয়ে নির্বাচন করিয়েছেন। আবার অনেক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কাজ করেছেন। তারা ক্ষমা পাবেন কিন্তু তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ দেওয়া হবে না। যতই ক্ষমা করে দেওয়া হোক না কেন, আগামী নির্বাচনে এসব বিষয় মাথায় রেখে সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ।

দলীয় সূত্র মতে, তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১টি জেলা পরিষদে নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদ নির্বাচন স্থগিত করেন আদালত।

৬১ জেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন ৪৮ জন। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ২৬ জন। আর সাত জেলায় বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। সেগুলো হলো- রংপুর, পটুয়াখালী, শেরপুর, নরসিংদী, ফরিদপুর, সুনামগঞ্জ ও কক্সবাজার। এছাড়া দিনাজপুর ও ঝিনাইদহে বিজয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। অন্যদিকে, পঞ্চগড় ও চাঁদপুরে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

ক্ষমতাসীনরা ৪৮ জেলায় পাস করলেও ৯২টি উপজেলায় কম ভোট পেয়েছেন দলীয় প্রার্থীরা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কেউ কম-বেশি ভোট পেতেই পারে। কারণ, এটা জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় নির্বাচন। এখানে ভোটার হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বা যারা উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান। এটা হচ্ছে আইয়ুব খানের সময় যে রকম ভোট ছিল, সেই কৌশলের ভোট। এসব ভোটে বহু রকমের কৌশল হয়েছে। টাকা-পয়সার খুব খেলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নৌকার বিরুদ্ধে যারা প্রার্থী তারা টাকা-পয়সা দিয়ে ভোট কিনে নিয়েছেন। তাদের অবস্থা কী হবে এখন বলা যাবে না।’

ক্ষমতায় থেকেও নৌকার মনোনীত প্রার্থী ৯২ উপজেলায় কেন কম ভোট পেয়েছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে বিজয়ী প্রার্থীরা বলেছেন, দলীয় কোন্দল আর গ্রুপিংয়ের কারণে নৌকার মনোনীত প্রার্থীরা বিভিন্ন উপজেলায় কম ভোট পেয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতির সমীকরণেও ভোট কম পাওয়ার প্রভাব রয়েছে বলে জানান তারা।

কেউ কেউ বলছেন, জেলা আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের মধ্যেও লড়াই হয়েছে। মন্ত্রীপরিষদের অনেক মন্ত্রীর জেলায়ও একই রকম চিত্র দেখা গেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে কেন্দ্র কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে বলেও জানান বিজয়ীরা।   

যেসব জেলায় পরাজিত ও কম ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা-

পঞ্চগড় : আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মো. আবু তোয়বুর রহমান। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মো. আ. হান্নান ও মো. দেলদার নির্বাচন করেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল হান্নান শেখ। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হওয়ার অন্যতম কারণ সদর ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় কম ভোট। দুই উপজেলায় মোট ভোটার ছিল ২৯২টি। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ১১৪টি, হান্নান শেখ পেয়েছেন ১৪৯টি এবং মো. দেলদার পেয়েছেন ২৫টি ভোট। 

দুই উপজেলার ভোটে কপাল পুড়েছে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর।

পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আবু তোয়বুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরাজিত হওয়ার কারণ মূলত দলীয় কিছু লোকের ষড়যন্ত্র। বিশেষ করে মন্ত্রীমহোদয়ের (নূরুল ইসলাম সুজন)। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অসহযোগিতা করেছেন স্বয়ং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ‘আমি হারিনি, আমাকে হারানো হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটকে মনোনয়ন দেয় নাই বলে সেও কিছু ক্ষতি করেছে। এক রাতেই উপজেলা চেয়ারম্যানদের টাকা দিয়ে আমার ৩০/৪০টা ভোট নষ্ট করেছে।’

এই বিষয়ে জানতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনকে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

দিনাজপুর : এখানে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন দিনাজপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে সহস্রাধিক ভোট বেশি পান তিনি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজিজুল ইমাম চৌধুরী ভোট পান শতকের নিচে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১৩ উপজেলার মধ্যে পার্বতীপুর উপজেলায় পান শূন্য ভোট, বাকিগুলোতে অন্যান্য প্রার্থীর তুলনায় কম ভোট পান। এই জেলায় আটজন সংসদ সদস্য থাকার পরও দলীয় প্রার্থী হেরে যাওয়া রহস্যজনক বলছেন স্থানীয়রা।

রংপুর : আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছাদ্দেক হোসেন বাবলু মোটরসাইকেল প্রতীকে ৬০১ ভোট পেয়ে জয় লাভ করেন। অপরদিকে দলীয় মনোনয়ন পেলেও ভোটযুদ্ধে আনারস প্রতীক নিয়ে ৪৮৪ ভোট পেয়ে হেরে যান রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আহমেদ।

রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার ১০৯৫ ভোটারের মধ্যে ১০৮৫ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। জেলার তারাগঞ্জ উপজেলার ৬৮ ভোটের মধ্যে ১৭, গংগাচড়ায় ১২০ ভোটের মধ্যে ৫১, মিঠাপুকুরে ২২৪ ভোটের মধ্যে ৮৫, পীরগাছায় ১২০ ভোটের মধ্যে ৫০, কাউনিয়ায় ৯৪ ভোটের মধ্যে ৪৬ এবং সদর উপজেলায় ১১৩ ভোটের মধ্যে ৪৫ ভোট পান ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। সব উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থীর তুলনায় কম ভোট পান নৌকা-সমর্থিত প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হারার কারণ আমাদের নেতৃবৃন্দ নৌকার সঙ্গে বেইমানি করেছেন। আমাদের লোকেরাই আমার বিপক্ষে কাজ করেছেন। বাইরের লোকেরা এত সাহস পাবে কই থেকে? দলের লোকেরাই সব করেছে। তারা কেনাবেচা হয়েছে।’  

গাইবান্ধা : আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবু বকর সিদ্দিক নির্বাচিত হন। তালগাছ প্রতীক নিয়ে তিনি পান ৫৮৩ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতাউর রহমান আতা পান ৫২৩ ভোট। সাত উপজেলার মধ্যে সাঘাটায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পান ৫৪ ভোট আর জাতীয় পাটি সমর্থিত প্রার্থী পান ৭২ ভোট। সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পান ৮৩ ভোট, জাতীয় পাটি সমর্থিত প্রার্থী পান ১২৬ ভোট। দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হলেও দুই উপজেলায় কম ভোট পান তারা।

বগুড়া : আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মকবুল হোসেন বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত আব্দুল মান্নান আকন্দ। জেলার ১২টি উপজেলা, ১২টি পৌরসভা ও ১০৯টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত বগুড়া জেলা পরিষদ। এই নির্বাচনে নৌকা মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হলেও চার উপজেলায় ভোট কম পান। কাহালু উপজেলায় ১৪৬ ভোটের মধ্যে নৌকার প্রার্থী ৪৮, শাজাহানপুরে ১৩২ ভোটের মধ্যে ৫৮, শেরপুরে ১২০ ভোটের মধ্যে ৫৫, সারিয়াকান্দিতে ১৪৬ ভোটের মধ্যে ৬৫ এবং সোনাতলায় ১৪৬ ভোটের মধ্যে ৫৬ ভোট পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

রাজশাহী : বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল বিজয়ী হন। মাত্র ৩২ ভোট বেশি পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।

মীর ইকবাল কাপ-পিরিচ প্রতীকে পান ৫৯৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) আক্তারুজ্জামান আক্তার পান ৫৬৬ ভোট। জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে পুঠিয়ায় মীর ইকবাল পান ৪৫ ভোট, আখতার পান ৪৯ ভোট। পবায় মীর ইকবাল পান ৮১ ভোট, আখতার পান ৮৮ ভোট। মোহনপুরে মীর ইকবাল পান ৪৮ ভোট, আখতার পান ৪৮ ভোট। বাগমারায় মীর ইকবাল পান ১১২ ভোট, আখতার পান ১২১ ভোট। গোদাগাড়ীতে মীর ইকবাল পান ৬৮ ভোট, আখতার পান ৭৪ ভোট।

চুয়াডাঙ্গা : আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মাহফুজুর রহমান মনজু মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। তিনি ৩১১ ভোট পেলেও তার নিকটতম প্রার্থী জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলম রনজু ঘোড়া প্রতীকে পান ২৪৯ ভোট। নৌকা সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হলেও সদর উপজেলায় ১১৯ ভোটের মধ্যে ৫৬ এবং আলমডাঙ্গা উপজেলায় ২১১ ভোটের মধ্যে ৮০ ভোট পান তিনি। ওই দুই উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি ভোট পান।

ঝিনাইদহ : এখানে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুন অর রশিদ। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী কনক কান্তি দাসকে মাত্র ১৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী চশমা প্রতীক নিয়ে পান ৯৭ ভোট, আনারস প্রতীক নিয়ে হারুন অর রশিদ পান ১২২ ভোট। শৈলকুপায় চশমা প্রতীক পায় ৮৭ ভোট, আনারস প্রতীক পায় ১০৯ ভোট। এই দুই উপজেলার কম ভোটে কপাল পোড়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী কনক কান্তি দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অধিকাংশ দলীয় লোকের অসহযোগিতা এবং তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আমার পরাজয় ঘটেছে। প্রতিপক্ষ মোটা অঙ্কের টাকার দিয়ে ভোট কিনে নেয়। সেই প্রমাণও আমার কাছে আছে। সব জায়গায় এমপিদের প্রতিপক্ষ আছে। এখানে পাস করলে এমপির গুরুত্ব বেড়ে যায়। তাই এমপির প্রতিপক্ষরা মরিয়া হয়ে ওঠে এবং আমার প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নেয়। তারা দেখাতে চাইছে যে এমপির ভোট নাই, এমপির জনসমর্থন নাই।’

নড়াইল : চেয়ারম্যান পদে এখানে বিজয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবাস চন্দ্র বোস। তিনি ২৬০ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ ফয়জুল আমির পান ১৭৮ ভোট। এছাড়া আরেক ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী জেলা পরিষদের প্রশাসক শেখ মো. সুলতান মাহমুদ ১১৩ ভোট পান। কিন্তু সদর উপজেলায় ৬৫ ভোটের মধ্যে মাত্র ২৬ ভোট পান তিনি।

খুলনা : জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ আবারও নির্বাচিত হন। তিনি পান ৫৩৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম এম মোর্ত্তজা রশিদী দারা পান ৪০৩ ভোট। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও বিএমএ খুলনার সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম পান ৩৭ ভোট। তবে, খুলনার ডুমুরিয়ায় ১৮ ভোটের মধ্যে ৮৩, তেরখাদায় ৮১ ভোটের মধ্যে ৩২ এবং রূপসায় ৬৮ ভোটের মধ্যে ৩২ ভোট পান তিনি। এই তিন উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী কম ভোট পান।

সাতক্ষীরা : চেয়ারম্যান পদে আবারও নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো.  নজরুল ইসলাম। তিনি পান ৬০৮ ভোট। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী এম খলিলুল্লাহ ঝড় পান ৪৫১ ভোট। নজরুল ইসলাম টানা দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও দেবহাটা উপজেলায় কম ভোট পান।

পটুয়াখালী : আওয়ামী লীগের প্রার্থী খলিলুর রহমান মিয়াকে পরাজিত করে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান হাফিজ। এই জেলায় তিনি ৫৮২ ভোট পান। আওয়ামী লীগের প্রার্থী পান ৪৮৬ ভোট। বাউফলে ২০৯ ভোটের মধ্যে ৬০, দশমিনায় ৯৪ ভোটের মধ্যে ৩৭, গলাচিপায় ১৭১ ভোটের মধ্যে ৭৮ ভোট পান নৌকা সমর্থিত প্রার্থী।

শেরপুর : আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবং জেলার সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল পরাজিত হন। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবীর রুমান ৫৪৯ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী পান মাত্র ১৮৭ ভোট। সদর উপজেলায় ১৯৮ ভোটের মধ্যে ৫৩, শ্রীবরদীতে ১৪৬ ভোটের মধ্যে ৪০, নকলায় ১৩৩ ভোটের মধ্যে ২৯, নালিতাবাড়িতে ১৭২ ভোটের মধ্যে ৫২, ঝিনাইগাতীতে ৯৪ ভোটের মধ্যে ১৩ ভোট পান তিনি।

ময়মনসিংহ : বিজয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন জেলা জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চশমা প্রতীকের প্রার্থী আমিনুল ইসলাম। তবে, তারাকান্দা উপজেলায় ১৩৩ ভোটের মধ্যে ৪২, ঈশ্বরগঞ্জে ১৫৯ ভোটের মধ্যে ৫৮, ত্রিশালে ১৭২ ভোটের মধ্যে ৭৩ ভোট পান তিনি। বিজয়ী হলেও এই তিন উপজেলায় কম ভোট পান আওয়ামী লীগ সমর্থিত এই প্রার্থী।

কিশোরগঞ্জ : আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান নির্বাচিত হন। তিনি পান ৯৫৩ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির আশরাফ উদ্দিন পান ২৫৭ ভোট। তবে, কটিয়াদী উপজেলায় ১৩৩ ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পান মাত্র ৩৮ ভোট।

মানিকগঞ্জ : জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম মহিউদ্দীন প্রত্যাশার চেয়ে কয়েকগুণ কম ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে মোট ৮৮৯ ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনারস প্রতীক নিয়ে ৪৫২ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন গোলাম মহীউদ্দীন। অন্যদিকে, তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চশমা প্রতীকের প্রার্থী কে এম বজলুল হক খান রিপন ৪২৫ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। সাটুরিয়া উপজেলার ১১৯ ভোটের মধ্যে ৫৮ এবং সিংগাইর উপজেলায় ১৫৯ ভোটের মধ্যে ৩৮ ভোট পান গোলাম মহিউদ্দীন। এই দুই উপজেলায় কম ভোট পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

গাজীপুর : আওয়ামী লীগের সমর্থিত মোতাহার হোসেন মোল্লা ৩৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোকছেদ আলম ২৯৪ ভোট পান। অপর প্রার্থী সামসুদ্দিন খন্দকার পান তিন ভোট। তবে শ্রীপুর, সদর ও কালিগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী কম ভোট পান।

নরসিংদী : স্বতন্ত্র প্রার্থী মনির হোসেন ভূঁইয়া ৬২২ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক আব্দুল মতিন ভূঁইয়া পান ৩৫০ ভোট। অপর প্রার্থী সৈয়দ মাহমুদ জাহান লিটু পান ২১ ভোট। জেলার সব উপজেলায় কম ভোট পান আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। সদর উপজেলায় ২১৪ ভোটের মধ্যে ৯৪, পলাশে ৬৮ ভোটের মধ্যে ২৫, রায়পুরায় ২৩৬ ভোটের মধ্যে ৮৯, শিবপুরে ১২৬ ভোটের মধ্যে ৪৭, মনোহরদীতে ১৭২ ভোটের মধ্যে ৫৪ এবং বেলাবোতে ১০৭ ভোটের মধ্যে ৪১ পান আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী।

ফরিদপুর : ফরিদপুরে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের ফারুক হোসেন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ৮৫ ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি পান ৬২৫ ভোট, আওয়ামী লীগের প্রার্থী পান ৫৪০ ভোট। নয় উপজেলায় মোট ভোটার ১১৮১ জন। জেলার বোয়ালমারী উপজেলায় ১৪৬ ভোটের মধ্যে ৭৯, নগরকান্দায় ১৩৩ ভোটের মধ্যে ৪৮, সালথায় ১০৭ ভোটের মধ্যে ৩০, ভাঙ্গায় ১৭১ ভোটের মধ্যে ৩৯, সদরপুরে ১২০ ভোটের মধ্যে ৩৬ এবং চরভদ্রাসনে ৫৫ ভোটের মধ্যে ২০ ভোট পান আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী। এসব উপজেলায় কম ভোটের কারণে হারতে হয় ফারুক হোসেনকে।

সুনামগঞ্জ : আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়রুল কবীর রুমেনকে পরাজিত করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল হুদা মুকুট। স্বতন্ত্র প্রার্থী মোটরসাইকেল প্রতীকে পান ৬১২ ভোট। আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী রুমেন ঘোড়া প্রতীকে পান ৬০৪ ভোট। জেলার সদর উপজেলা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলায় কম ভোট পান আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী। যে কারণে হেরে যান ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার। তিনি পান ৮২২ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি শফিকুল আলম পান ৫৫৩ ভোট। তবে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী তিন উপজেলায় কম ভোট পান। সদর উপজেলার ১৬৩ ভোটের মধ্যে ৭৪, নাসিরনগরে ১৭২ ভোটের মধ্যে ৭১, সরাইলে ১২০ ভোটের মধ্যে ৫০ পান তিনি।

কক্সবাজার : চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাহীনুল হক মার্শাল। তিনি ৫৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমদ চৌধুরী পান ৩৯৫ ভোট। এখানেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজিত হওয়ার পেছনের কারণ হলো কম ভোট। তিনি জেলার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় কম ভোট পান।

এছাড়া আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীরা ২৬ জেলা পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেগুলো হচ্ছে- ফেনী, ভোলা, কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর, ঝালকাঠি, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, ঢাকা, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, বাগেরহাট, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ ও সিলেট।

এমএসআই/এমএআর/