আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ (৮ মার্চ)। ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’— এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পেশা হলো ‘পুলিশ’। বাংলাদেশ পুলিশে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে কাজ করছেন।

২০২১ সালের ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত মোট জনবলের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৯ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ২৩৯ জন। যা ছিল মোট জনবলের ৮.০২ শতাংশ। সেখান থেকে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাহিনীটিতে নারী সদস্যের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ২৭৭ জন। যা বর্তমানে বাহিনীটির মোট জনবলের মাত্র ৮.১৮ শতাংশ।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশ থেকে ৪০ ভাগ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা পাওয়ার কথা উল্লেখ করে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ডিআইজি ও পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের (বিপিডব্লিওএন) সভাপতি আমেনা বেগম বলেছেন, বাহিনীতে নারী সদস্যের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। যদি নারী সদস্য না বাড়ে তাহলে শান্তিরক্ষা মিশনেও চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ নারী জনবল পাঠানো সম্ভব না। নারী পুলিশের সংখ্যা ২৫ শতাংশ হওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

সমতা, উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অংশীদার হিসেবে পিছিয়ে থাকবে না নারী। এমন অঙ্গিকার নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ সব ক্ষেত্রেই নারীদের জয়জয়কার। পুলিশেও পিছিয়ে নেই নারীরা। তবে তুলনায় অন্তর্ভুক্তি খুবই কম

সমতা, উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার অংশীদার হিসেবে পিছিয়ে থাকবে না নারী। এমন অঙ্গিকার নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে আজ সব ক্ষেত্রেই নারীদের জয়জয়কার। পুলিশেও পিছিয়ে নেই নারীরা। তবে তুলনায় অন্তর্ভুক্তি খুবই কম।

যদিও বরাবর পুলিশপ্রধান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীতে ক্রমেই বাড়ছে নারীর প্রাধান্য। যোগ্যতা ও সুযোগ অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি ও দায়িত্ব পাচ্ছেন তারা। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও বাড়ছে নারী পুলিশের অংশগ্রহণ। মিলছে স্বীকৃতিও। পুলিশকে নারীবান্ধব হিসেবে ঘোষণা করেছেন তারা।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেলেও নারীর প্রতি মানসিকতা, নারীর নিরাপত্তা, সব সেক্টরে নারীর সমান অন্তর্ভুক্তি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।

উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার পাশাপাশি নারীর উন্নতি, অগ্রগতি ও সহিংসতারোধ, আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর সম্পৃক্ততা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি কর্মক্ষেত্রও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো হতে পারে রোল মডেল।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেলেও নারীর প্রতি মানসিকতা, নারীর নিরাপত্তা, সব সেক্টরে নারীর সমান অন্তর্ভুক্তি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর পুলিশ বাহিনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম ১৯৭৪ সালে আটজন নারী কনস্টেবল নিয়োগ দেন। তবে, তারা কাজ করতেন সাদা পোশাকে। ১৯৭৪ সালে স্পেশাল ব্রাঞ্চে মোট ১৪ জন নারীকে নিয়ে নারী পুলিশের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। এর মধ্যে সাতজন ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর এবং সাতজন নারী কনস্টেবল। পুলিশের পোশাকে নারী সদস্যদের নিয়োগ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। মাত্র ১১ জন নারী সদস্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে। ১৯৮৬ সালে প্রথম সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে ফাতেমা বেগমের যোগদানের মাধ্যমে পুলিশের উচ্চপর্যায়ে (বিসিএস) নারী নিয়োগ শুরু হয়। এখন পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসে নারীর অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ চালু করেন। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে আটজন নারী সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নারীদের প্রবেশাধিকার আবার উন্মুক্ত হয়।

বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত মোট নারীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৪০২, যা ছিল সে সময়কার পুলিশের মোট জনবলের ৭.১০ শতাংশ।

পুলিশে উচ্চপর্যায়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রথম শ্রেণির নারী পুলিশ কর্মকর্তা ২৯৪ জন। এর মধ্যে ডিআইজি (গ্রেড-৩) চারজন, অতিরিক্ত ডিআইজি ২৩ জন, পুলিশ সুপার ৬৫ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১২১ জন এবং সহকারী পুলিশ সুপার ৮১ জন

২০২১ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ সদরদপ্তরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তখন বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত মোট জনবলের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৯ জন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৯ জন। যা মোট জনবলের ৮.০২ শতাংশ।

এ বছর পুলিশ সদরদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, ২০২২ সালের অক্টোবরের তথ্যানুযায়ী, পুলিশ বাহিনীতে মোট জনবল এক লাখ ৮৯ হাজার ৫৬০ জন। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৫১৬ জন নারী সদস্য। যা মোট জনবলের মাত্র ৮.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এক বছরে পুলিশে নারী জনবল বেড়েছে মাত্র ২৭৭ জন। শুধু তা-ই নয়, বাহিনীতে কমেছে জনবলের সংখ্যাও। গত বছরের তুলনায় মোট জনবল থেকে উল্টো কমেছে ২৩৯ জন।

পুলিশ সদরদপ্তরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পুলিশের উচ্চপর্যায়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রথম শ্রেণির নারী পুলিশ কর্মকর্তা ২৯৪ জন। এর মধ্যে ডিআইজি (গ্রেড-৩) চারজন, অতিরিক্ত ডিআইজি ২৩ জন, পুলিশ সুপার ৬৫ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১২১ জন এবং সহকারী পুলিশ সুপার ৮১ জন।

এছাড়া ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ১১৩ জন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ৮৪৯ জন, সার্জেন্ট ৫৮ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) এক হাজার ১৩৯ জন, এএসআই (সশস্ত্র) ১৪ জন। নায়েক ৩০৬ জন ও নারী কনস্টেবল ১২ হাজার ৭৪৩ জন।

বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিওএন) সূত্রে জানা যায়, নারী পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব ও দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৮ সালে চালু করা হয় ‘উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক।’

২০১২ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় নারী পুলিশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী পুলিশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়। ১৯৮৮ সালে ইরাকের দাঙ্গা মেটাতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বপ্রথম অংশ নেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। সেই থেকে বিশ্বের ২৭টি মিশনের দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন তারা। এখন তারা কাজ করছে বিভিন্ন দেশে। দ্বিতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী সরবরাহকারী রাষ্ট্রের মর্যাদায় রয়েছে বাংলাদেশ।

২০০০ সালে পাঁচ নারী পুলিশের একটি টিম প্রথমবারের মতো শান্তিরক্ষা মিশনে পূর্ব তিমুরে অংশ নেয়। পরবর্তী সময়ে নানা কারণে আর নারী পুলিশের কোনো টিম মিশনে অংশ নেয়নি। ১০ বছর পর ২০১০ সালে নারী পুলিশের প্রথম কনটিনজেন্ট পাঠানো হয় হাইতি মিশনে। এ কনটিনজেন্টে ছিল নারী পুলিশের ১৬৮ সদস্য। এর মধ্য দিয়ে ব্যাপক আকারে শান্তি মিশনে নারী পুলিশের যাত্রা শুরু হয়। 

চলতি বছরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মালি, কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান ও লিবিয়ায় ১৫১ নারী পুলিশ কর্মরত আছেন।

পুলিশ বাহিনীতে নারীর অগ্রগতি সম্পর্কে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ডিআইজি ও পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের (বিপিডব্লিওএন) সভাপতি আমেনা বেগম বলেন, সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় বাড়াতে হবে নারীর অংশগ্রহণ। পুলিশে নারী সদস্যরা কর্মদক্ষতার মধ্য দিয়ে শান্তি মিশনেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে পৌঁছে গেছে শীর্ষ অবস্থানে।

তবে তিনি বলেন, জাতিসংঘ ৪০ শতাংশ নারী শান্তিরক্ষী চায়। সেখানে আমাদের পুলিশের নারী সদস্যের সংখ্যা প্রায় ২৬ শতাংশ। সেটা বাড়াতে হলে তো বাহিনীতে আগে নারী সদস্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

এক বছরে মাত্র ২৭৭ জন নারী জনবল বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, করোনাকালে কৃচ্ছতা সাধন নীতি মেনে চলেছে পুলিশ। পরিকল্পনার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে আশা করছি, এ বছর সেটি বদলে যাবে। বাহিনীতে বাড়বে নারীদের অন্তর্ভুক্তি।

পুলিশে নারী জনবল বৃদ্ধির ধীরগতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলেও পুলিশ সদরদপ্তরের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা (এইচআরএম) বিভাগের ডিআইজির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে, শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের স্ট্যান্ডার্ড ফলো করতে হলে পুলিশে নারী জনবল বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্য দেশগুলোর তো খবরই নেই। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী সদস্য দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানে রয়েছে।

‘অবশ্যই এটা ভালো সুযোগ। সবকিছু মিলিয়ে বাহিনীতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। চ্যালেঞ্জিং পেশা মনে করে পিছিয়ে থাকার সুযোগ আর নেই। জেন্ডার ইকুয়ালিটির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশে নারীর অংশগ্রহণকে বাড়াতে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।’

এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘সংখ্যায় নয়, জনবান্ধব পুলিশিং, সেবা ও আস্থার এক সম্মিলিত উচ্চারণ নারী পুলিশ। নারীর সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, দেশের সব থানায় নারী ও শিশু ডেস্ক রয়েছে। এখানে নারীরা তাদের যেকোনো সমস্যার কথা নারী পুলিশ সদস্যদের কাছে বলতে পারেন। নারী-শিশুর নিরাপত্তাবোধ তৈরিসহ মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে পুলিশের নারী সদস্যদের প্রতি অধিক জনপ্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে।

জেইউ/ওএফ