আনজুমান আরা। বিসিএস ২১তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে ঝিনাইদহে সহকারী কমিশনার পদে কর্মজীবন শুরু করেন। বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনে মাঠ প্রশাসনে একাধিক জেলায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এই কর্মকর্তা। সর্বশেষ নড়াইল জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিশাখায় যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত।
 
সম্প্রতি তিনি ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়ে উন্মোচন করেছেন প্রশাসনে নারীদের প্রতিবন্ধকতা, বর্তমান অবস্থান ও সফলতার নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।
 
ঢাকা পোস্ট : আজকাল নারীদের সমান অধিকারের কথা বলা হচ্ছে। সব জায়গাতে কি সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে? 
আনজুমান আরা : নারীদের সমান অধিকারের জায়গাটি আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মাত্রা বা লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও আমরা অনেকটা এগিয়েছি। বর্তমানে সব জায়গাতেই নারীরা কাজ করছেন। মাঠের শ্রমিক থেকে শুরু করে আমাদের প্রশাসনেও নারীদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে; এটা ইতিবাচক। তবে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে সমানভাবে নারীরা পৌঁছাতে পারেননি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এখনও সচেতনতার অভাব স্পষ্ট। শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে মেয়েদের অবস্থান খুব ভালো। কিন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম।
 
চাকরির ক্ষেত্রেও পুরুষের সঙ্গে মেয়েরা সমানভাবে আসতে পারেনি। এক্ষেত্রে মেয়েদের সেকেলে মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। অনেক মেয়েই নিজস্ব ও পারিবারিক বলয় থেকে চিন্তা করেন যে চাকরি করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া অনেক মেয়ে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার যে স্পৃহা, পরিবেশ ও সুযোগ থাকা প্রয়োজন সেটা পরিবার থেকে পান না।
 
ঢাকা পোস্ট : মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতায় নারীদের অবস্থান কাছে থেকে দেখেছেন। প্রশাসনে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই... 
আনজুমান আরা : প্রশাসনে নারীদের অবস্থান অনেক ভালো। আমি নেতিবাচক কিছুই দেখিনি। তবে এখনও পদায়নের ক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীরা যেভাবে পোস্টিং পাচ্ছেন মেয়েদের সেভাবে দেওয়া হচ্ছে না। এ সংখ্যাটা এখনও কমিয়ে রাখার প্রবণতা রয়েছে। তবে কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মী হওয়াতে বৈষম্যের ঘটনা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে পারলে প্রশাসনে নারীদের প্রতিবন্ধকতা নেই বললেই চলে। তবে নিম্ন লেভেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীরা প্রতিবন্ধকতার শিকার হন। বস পুরুষ হলে এ প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে।
 
ঢাকা পোস্ট : বর্তমানে নারীরা পুলিশ, প্রশাসন ও রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? 
আনজুমান আরা : বিষয়টি ইতিবাচক। কারণ, আমাদের ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাতকে সমানভাবে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছি। এই এগিয়ে চলার ভীত রচনা করে গিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে কাজ করেছেন। তিনি যে ভীত রেখে গিয়েছেন সেটার ওপর দাঁড়িয়েই আজকের বাংলাদেশ এই অবস্থানে এসেছে। তারই যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত হাতে জাতির পিতার রেখে যাওয়া ভীতকে আরও অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে নিয়ে গেছেন।


 
এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আমরা এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত হয়েছি। অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে আমাদের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। যে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, এই সম্পৃক্ততা আরও বাড়াতে হবে। ছেলে-মেয়ে বিভেদ না করে সবাইকে নাগরিক হিসেবে সমান তালে এগোতে হবে। ছেলে-মেয়ের এই বিভেদ ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে রাখা যাবে না। একজন মানুষ হিসেবে আমাদের মেয়েদেরও মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। নিজের মেধা, দক্ষতা ও প্রচেষ্টা দিয়ে এগিয়ে চলতে হবে। ব্যবসা হোক বা সরকারি-বেসরকারি চাকরি; সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের সফলতা অর্জন সম্ভব। এখন আমাদের সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। একজন মেয়ে কাজ করতে চাইলে সুযোগ ও পরিবেশ দুটোই আছে।
 
ঢাকা পোস্ট : একজন নারী হিসেবে আপনার বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই... 
আনজুমান আরা : আমি খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলায় কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। তখন ও এখনকার সময়ের তফাত বিস্তর। তখনও যে খুব বেশি প্রতিবন্ধকতা বা বৈষম্যের শিকার হয়েছি বিষয়টা এমন নয়। তবে একটি প্রচলিত প্রথায় আমরা পড়েছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে এ কাজগুলো শুধু ছেলেরাই পারবে; মেয়েরা পারবে না। তবে এ জায়গা থেকে এখন আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছি। আজকাল জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার থেকে শুরু করে যে কোনো সার্ভিসেই মেয়েরা অনেক ভালো করছে। তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে। আমাদের মেয়েদের আজও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। এখনও সমাজ আমাদের প্রতি সেভাবে বিশ্বাস রাখতে পারে না। আমাদের প্রমাণ দিতে হয় যে আমিও পারি বা পারব। সেই জায়গাটা আগের থেকে পরিবর্তন হলেও এখনও বিদ্যমান।
 
ঢাকা পোস্ট : নারী কর্মকর্তা হওয়ায় পুরুষ সহকর্মীর কটূক্তির শিকার হয়েছেন কি না? 
আনজুমান আরা : আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা, বৈষম্য বা প্রতিহিংসার শিকার হইনি।
 
ঢাকা পোস্ট : কর্মস্থলে নারীদের নিরাপত্তার জন্য আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ রয়েছে কি না?
আনজুমান আরা : কর্মস্থলে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই কাজ করছি। সব অফিসে মায়েরা যাতে বাচ্চাদের পরিচর্যা করতে পারেন সেজন্য ডে কেয়ার করা হয়েছে। যদি কেউ ইভটিজিংয়ের শিকার হন তার জন্য কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা রয়েছে। এ জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমি নিজেও রাত ২-৩টা পর্যন্ত কাজ করেছি। সমস্যা হয়নি। তবে আমাদের সামাজিক কিছু প্রতিবন্ধকতা তো আছে। এখনও পুরুষের সঙ্গে নারীদের রাতে কাজ করার বিষয়টি সমাজ ভিন্ন চোখে দেখে। তবুও আগের ধারণা অনেক পাল্টে গেছে।
 
ঢাকা পোস্ট : একজন নারী হিসেবে এগিয়ে চলার পথে কোনো পুরুষের অনুপ্রেরণার গল্প যদি থাকে... 
আনজুমান আরা : আমার এগিয়ে চলার পেছনে আমার বাবা ও স্বামী— দুটি মানুষের অনুপ্রেরণা রয়েছে। এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে যেখানে যেটা প্রয়োজন বাবা-মা সবসময় সে সুযোগ দিয়েছেন। জীবনের শুরু থেকে আমাকে উচ্চশিক্ষিত করতে বাবা সবসময় ভাবতেন। আমার চাকরির আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমার স্নাতক শেষ হওয়ার পর বিয়ে হয়ে। সেক্ষেত্রে আমার স্বামী অনেক সহযোগিতা করেছেন। তিনি আমার থেকে সিনিয়র থাকায় তার বিসিএসের নোটস বা পড়াশোনার গাইডলাইন, সেগুলো দিয়েছেন। আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। এখনও আমার কর্মজীবনে আমার স্বামীর যথেষ্ট সহযোগিতা রয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরতে দেরি হলেও মানুষটা সবসময় পাশে থেকেছেন। আমাকে তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি না থাকলে আজকের এই আমি অনেকটা অসম্পূর্ণই থাকতাম। আজকের এই অবস্থানে আসার জন্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার বাবা ও স্বামী ইতিবাচকভাবে সহযোগিতা করেছেন।
 
ঢাকা পোস্ট : এবারের নারী দিবসে আপনার চাওয়া কী? 
আনজুমান আরা : আমার একটাই চাওয়া। আমরা সবাইকে সন্তান হিসেবে দেখতে চাই। পারিবারিক বলয় থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বলয়ে সব ক্ষেত্রেই যেমন প্রচণ্ড আস্থা থাকে; মেয়েদের ক্ষেত্রেও সেই আস্থা ও সুযোগটা চাই। এখনও নারীদের প্রতি শত ভাগ আস্থা আসেনি। এখন সবাই স্বীকার করেন মেয়েরা সবকিছুই পারে; তবুও বিষয়টি সমাজে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এবারের নারী দিবসে আমার প্রত্যাশা থাকবে, একজন নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষ সবাই সমান সুযোগ পাবে। একইসঙ্গে আমাদের চেষ্টা, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে সবাই সমান তালে এগিয়ে যাব সমৃদ্ধ আগামীর অগ্রযাত্রায়। এটা করতে পারলেই আমাদের সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় এবং শত বার্ষিক পরিকল্পনা আরও ফলপ্রসূ হবে। জাতির জনক যে স্বপ্ন দেখতেন এবং প্রধানমন্ত্রী যে স্বপ্ন দেখেন, সেই সোনার বাংলা ও স্মার্ট বাংলাদেশ আরও বেশি অর্থবহ হয়ে উঠবে।
 
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। নারী দিবসের শুভেচ্ছা। 
আনজুমান আরা : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা।
 
এমএম/কেএ