বাংলাদেশে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে আছে, তা পাশের দেশগুলো থেকে কোনো অংশেই কম নয় বলে মনে করি। এর মধ্যে দেশে আরও আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। এটি চালু হলে দেশের চিকিৎসা ও গবেষণা আরও অনেক সমৃদ্ধ হবে। আমরা চাই বাংলাদেশ থেকে কোনো রোগীকে যেন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে না হয়…

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ১১তম ভাইস চ্যান্সেলর (উপাচার্য)। গত ২৯ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হন দেশের প্রতিথযশা এ চিকিৎসক। বিএসএমএমইউসহ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে নানা পরিকল্পনার কথা জানান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক তানভীরুল ইসলাম

ঢাকা পোস্ট : দেশের চিকিৎসা ও গবেষণার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। আপনার অনুভূতিটা যদি বলতেন...

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : দায়িত্ব পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। এ ধরনের পদের প্রতি আমার কখনওই কোনো লোভ ছিল না, এখনও নেই। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কর্মরত। শুরু থেকে যারা এ চেয়ারে ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তাদের সবাইকে আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি। এখন আমি অন্যদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শিক্ষায়, সেবায় ও গবেষণায় এগিয়ে নিতে চাই।

স্পেশালাইজড এ হাসপাতালে সেবা নিতে এসে রোগীকে অন্য কোনো জায়গায় যেতে হবে না। হাসপাতালের ভেতরেই থাকবে কনভেনিয়েন্স শপ, ব্যাংকিং সুবিধা, ফার্মেসি, ৩৫০ সিটের উন্নত কিচেন, যার আওতায় তিনটি ক্যাফেটেরিয়া থাকবে। থাকবে ৯০ আসনবিশিষ্ট ডক্টরস ক্যাফেটেরিয়া, উন্নত লন্ড্রি হাউসসহ কার পার্কিংয়ের সুবিধা। থাকবে ভিভিআইপি এলিভেটরসহ ১৬টি এলিভেটর ও একটি এস্কেলেটর, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, হিটিং, ভেন্টিলেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হবে

আমি মনে করি, যেকোনো দায়িত্বই সঠিকভাবে এবং সততার সঙ্গে পালন প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে আল্লাহ তাকেই দায়িত্ব দেন, যিনি দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা রাখেন।

২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ঢাকা পোস্ট : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা ও গবেষণার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কাছে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা। উপাচার্য হিসেবে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন কি না?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : বাংলাদেশে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানে আছে, তা পাশের দেশগুলো থেকে কোনো অংশেই কম নয় বলে মনে করি। এর মধ্যে দেশে আরও আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েই একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে। এটি চালু হলে দেশের চিকিৎসা ও গবেষণা আরও সমৃদ্ধ হবে। আমরা চাই বাংলাদেশ থেকে কোনো রোগীকে যেন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে না হয়। 

আমরা জানি, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। আমাদের চিকিৎসকরা অনেক দক্ষ ও সমৃদ্ধ। যেকোনো দেশের চিকিৎসকের চেয়ে তারা কোনো অংশে কম নয়। সেটি প্রমাণ করে দিয়েছে করোনা। করোনার সময় দেশের বাইরে গিয়ে কেউ চিকিৎসা নেননি, তাহলে তারা সবাই কোথায় চিকিৎসা নিয়েছেন? সবাই বাংলাদেশেই চিকিৎসা নিয়েছেন। বাংলাদেশি চিকিৎসকরাই তাদের চিকিৎসা দিয়েছেন। তার মানে, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা অন্যান্য দেশের চিকিৎসকদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

আমরা চাইব এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও উন্নততর করতে। ভবিষ্যতে আমাদের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সুপার স্পেশালাইজড শিক্ষক ও চিকিৎসক যদি নিয়োগ দিতে পারি, আমি মনে করি যে বাংলাদেশ থেকে বাইরে আর কেউ চিকিৎসা নিতে যাবেন না। এটি করতে পারলে দেশের অর্থনীতি যেমন উন্নত হবে, সঙ্গে সঙ্গে রোগীদের দুর্ভোগও কমবে।

কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা প্রতি শুক্রবার ঢাকা থেকে চিকিৎসা দিতে গ্রামে চলে যান। আমি মনে করি এটি ভালো উদ্যোগ। গ্রামের লোকজন ঢাকায় এসে টাকা খরচ করে যেসব চিকিৎসকের চিকিৎসা নেবেন, তারাই যদি ওই গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা দেন, তাহলে রোগীরা গ্রামে বসেই স্পেশালাইজড চিকিৎসা পাবেন। আমি মনে করি এটি খুবই ভালো লক্ষণ। আমাদের বিশেষজ্ঞরা কষ্ট করেই গ্রামে যান। বিষয়টিকে আমরা উৎসাহিত করতে চাই। এভাবে যখন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় উন্নত চিকিৎসা চলে যাবে, তখন দেশের চিকিৎসা পদ্ধতি পাল্টে যাবে। একপর্যায়ে আর কাউকে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে না।

হাসপাতালটির নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার থেকে এক হাজার ৪৭ কোটি টাকা ঋণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে

একটা সময় লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, হার্ট সার্জারির জন্য অসংখ্য লোক বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে যেতেন। কিন্তু এখন আর যান না। কারণ, আমাদের চিকিৎসকরা এখন দক্ষতার সঙ্গে এসব রোগের চিকিৎসা দেশে করছেন। ভবিষ্যতেও যেন না যান, সেজন্য আরও বেশি দক্ষ চিকিৎসক আমরা তৈরি করতে চাই। তাদের আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে রোগীদের সেবা দিতে চাই।

ঢাকা পোস্ট : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে মানুষ কী কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি হবে ১২০০ বেডের অত্যাধুনিক হাসপাতাল। সারাবিশ্বের লেটেস্ট যত চিকিৎসা ও প্রযুক্তি রয়েছে, সব আমাদের এখানে থাকবে। আমাদের পাশের বিভিন্ন দেশে লিভার, কিডনি এমনকি হার্ট ট্রান্সপ্লান্টও হয়। আবার কোথাও কোথাও ক্যাডাভারিক কিডনি অর্থাৎ যে রোগী আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছেন, তার কিডনিও ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। যেটা আমাদের দেশে এখনও চালু হয়নি, ভবিষ্যতে হবে। তারপর কর্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট, ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্টসহ লেটেস্ট আরও যত চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, সেগুলোর সব আমাদের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতলে থাকবে। সেখানে চিকিৎসা যারা দেবেন তারা দেশে ও বিদেশে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে আসবেন। তাদের জন্য আমরা সেই ব্যবস্থা রাখব।

স্পেশালাইজড এ হাসপাতালে সেবা নিতে এসে রোগীকে অন্য কোনো জায়গায় যেতে হবে না। হাসপাতালের ভেতরেই থাকবে কনভেনিয়েন্স শপ, ব্যাংকিং সুবিধা, ফার্মেসি, ৩৫০ সিটের উন্নত কিচেন, যার আওতায় তিনটি ক্যাফেটেরিয়া থাকবে। থাকবে ৯০ আসনবিশিষ্ট ডক্টরস ক্যাফেটেরিয়া, উন্নত লন্ড্রি হাউসসহ কার পার্কিংয়ের সুবিধা। থাকবে ভিভিআইপি এলিভেটরসহ ১৬টি এলিভেটর ও একটি এস্কেলেটর, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, হিটিং, ভেন্টিলেশন ও এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

উন্নত চিকিৎসায় বাংলাদেশি চিকিৎসকরাও কোনো অংশে কম নয় : অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

এছাড়া এটি হবে সম্পূর্ণ আইটি বেইজড হাসপাতাল। এখানে থাকবে মেগা হসপিটাল ইনফরমেশন সিস্টেম, যার আওতায় ‘কাটিং এজ ইনফরমেশন’ সিস্টেমসহ নানাবিধ সুবিধা থাকবে। অটোমেটেড হসপিটাল ইনফরমেশন সিস্টেমের আওতায় ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগীরা প্রয়োজনীয় ওষুধও পাবেন।

ঢাকা পোস্ট : কবে নাগাদ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি উদ্বোধন হতে পারে?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে। নির্মাণাধীন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল দক্ষিণ কোরিয়ান সরকারের সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বর্তমানে কোরিয়ান ও বিএসএমএমইউর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরা করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট প্রাদুর্ভাব ও সংকটের মাঝেও দিন-রাত পরিশ্রম করে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের গতিশীল কর্মকাণ্ডে মহান বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটির উদ্বোধন করতে পারবেন বলে আশা করছি।

ঢাকা পোস্ট : হাসপাতালটির অবকাঠামো নিয়ে যদি কিছু বলতেন...

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : বিএসএমএমইউর উত্তর পাশে ৩.৮ একর (প্রায় ১২ বিঘা) জমির ওপর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এক হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের অনুমোদন মেলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে। হাসপাতালটির নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার থেকে এক হাজার ৪৭ কোটি টাকা ঋণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে। নির্মাণকাজ করছে হুন্দাই করপোরেশন কোরিয়া। যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে স্যামসাং কোরিয়া।

ঢাকা পোস্ট : সাধারণত সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রতি মানুষের একধরনের আস্থাহীনতা রয়েছে। তারা মনে করেন সরকারি হাসপাতালে ভালো সেবা পাওয়া যায় না। যে কারণে তারা প্রাইভেট হাসপাতালমুখী হন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : এ বিষয়ে আমি একটা কথা বলি, সাধারণত ভারতে এ জিনিসটা হয়। দেশটির সরকারি হাসপাতালের কোনো কোনো ওয়ার্ডে কুকুর শুয়ে আছে— এমনও দেখা যায়। আর ওখানে প্রাইভেট হাসপাতালের সেবা খুব উন্নত। কিন্তু বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেকয়টি ইনস্টিটিউট আছে, আমি মনে করি এগুলোতে খুবই উন্নত মানের চিকিৎসা হয়। ভালো চিকিৎসা হয় না, সেটা বলা যাবে না। যদি তাই হয়, তাহলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আট থেকে নয় হাজার রোগী প্রতিদিন কেন আসছে? এত মানুষ এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে, তার মানে এখানে রোগীদের আস্থা আছে। সুতরাং সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা হয় না, কথাটি বললে ভুল হবে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, এখানে নিয়মিত ভালো চিকিৎসা হচ্ছে। আমাদের এখানকার আইসিইউ বলেন, করোনা ইউনিট বলেন, প্লাস্টিক সার্জারি বলেন; সব জায়গাতেই সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আমি কখনই মেনে নিব না যে সরকারি হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা হয় না।

ভিআইপিরা দেশে চিকিৎসা না নিলে সাধারণ মানুষ আস্থা হারায় : অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

ঢাকা পোস্ট : প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে অন্য দেশে চলে যান। এটা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : এটা আইন করে বন্ধ করা যায় না। যেমন- সিগারেট খেলে ৫০ টাকা জরিমানা, রাস্তা থেকে কয়জনের বন্ধ করা গেছে? মানুষের মধ্যে নিজ থেকেই একটা অভিব্যক্তি আসা দরকার। তবে, কিছু মানুষ দেশের বাইরে যাবেই, আমরা ঠেকাতে পারব না। যেমন- কেউ কেউ নিজের ছেলে-মেয়ের বিয়ের বাজার করতে যান, সেটা কি ঠেকানো যায়? কেউ আবার বেড়াতে যাচ্ছেন, সেখানে চিকিৎসা করিয়ে চলে আসছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন যে পর্যায়ে আছে, সেটা অবশ্যই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়ে কম নয়। কারণ, করোনার সময়ই দেখেন, কেউ কিন্তু চিকিৎসা নিতে যাননি। দেশেই তারা চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সুস্থ আছেন। তার মানে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে আমরা সব চিকিৎসাই দিতে পারি।

যে মানুষগুলো বিদেশে চিকিৎসা করাচ্ছেন এবং সেখানে অর্থব্যয় করছেন, আমি মনে করি তাদের মোটিভেট করতে পারলেই হবে। আস্তে আস্তে তারা আর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন না। কারণ, দেশেই উন্নত বিশ্বের সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে এসেও বিভিন্ন দেশের রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে যান। আমি নিজেই ভারতের বেশ কয়েকজন রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা দেই, তারা এ দেশে এসে চিকিৎসা নেন। আমাদের অনেক চিকিৎসকের কাছেই বিভিন্ন দেশ থেকে রোগী আসেন, যা অনেকে জানেন না। তাদের অধিকাংশই ক্যান্সার, ইউরোলজি, অর্থপেডিক্সসহ বিভিন্ন বিভাগে এসে চিকিৎসা নেন।

ঢাকা পোস্ট : প্রতি বছর ভিআইপিরা, বিশেষ করে মন্ত্রী-এমপিরা সামান্য কিছু হলেই বিদেশে চলে যান চিকিৎসা নিতে। সেখানে সাধারণ মানুষ কীভাবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখবেন?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : এটা ঠিক বলেছেন। সাধারণ মানুষ সবসময় যাদের অনুসরণ করেন, তারাই যদি দেশে চিকিৎসা না নেন তাহলে সাধারণের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে না। সেক্ষেত্রে আমরা ভিআইপিদের মোটিভেট (অনুপ্রাণিত করা) করতে পারি, যেন তারা বিদেশে না যান। দেশেই চিকিৎসা নেন।

ঢাকা পোস্ট : বিদেশ থেকে অসংখ্য চিকিৎসক আমাদের দেশে আসেন। অনেকেই অনুমোদন ছাড়া দেশে এসে চিকিৎসা দেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : অন্য দেশের কোনো চিকিৎসক যদি অনুমোদন ছাড়া আমাদের এখানে চিকিৎসা দেন, তাহলে তাদের জরিমানা করা হয়। যারা তাদের আনেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হয়। এ বিষয়ে আমাদের আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার কথা হলো, বাইরে থেকে যদি কোনো চিকিৎসক আনতে হয়, তাহলে চিকিৎসা নয়, তারা টেকনোলজি (তথ্যপ্রযুক্তি) আদান-প্রদান করতে পারবেন। একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামের আয়োজন করা যেতে পারে যেখানে বাংলাদেশি চিকিৎসকরা থাকবেন। তাদেরকে তারা ভালো করে প্রশিক্ষণ দেবেন। এসব ক্ষেত্রে আমরা বিদেশি চিকিৎসকদের দেশে আসার অনুমতি দিতে পারি। কিন্তু চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের চিকিৎসকরাই উন্নত চিকিৎসা দিতে পারেন।

শিল্পীর চোখে বিএসএমএমইউয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল

ঢাকা পোস্ট : বিভিন্ন সময় উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির খবর আসে। এসব বিষয়ে আপনার ভূমিকা কী হবে?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : আমি মনে করি, যারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের মূল্যায়নটাও সঠিকভাবে হওয়া উচিত। আমিও যেন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করি, সেক্ষেত্রে আমাকেও সজাগ থাকতে হবে। সকলের সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে যেন উন্নততর পর্যায়ে নিতে পারি, সেই চেষ্টা থাকবে। আমি এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা চাই। যারা আমার পূর্বসূরি ছিলেন তাদের কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। সবার সহযোগিতা নিয়েই আমি কাজ করে যাব।

ঢাকা পোস্ট : দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। বিএসএমএমইউতে একদিকে করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ রোগীদেরও চিকিৎসা অব্যাহত আছে। কীভাবে এতকিছু সামলাচ্ছেন?

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ : আমাদের যে করোনা ইউনিট আছে সেখানে এত রোগী বেড়েছে যে কেবিনগুলোতে কোনো জায়গা নেই। আবার করোনা ছাড়াও অন্য রোগীদের চিকিৎসা চলছে। আমরা আলাদাভাবে দুটোরই ব্যবস্থাপনা করছি। কারণ, রোগীদের স্বার্থে আমাদের সেক্রিফাইস (ত্যাগ স্বীকার) করতে হচ্ছে। দুদিকে যাওয়া মানে অনেক কষ্ট, অনেক রিস্ক (বিপদ)। একটা মাস্ক পরে আট ঘণ্টা থাকা কিন্তু কঠিন। আর যারা পিপিই পরেন, তারা তো ওয়াশ রুমেই যেতে পারেন না। গরমে যে কী পরিমাণ ঘামেন... এ বিষয়গুলো কিন্তু কেউ খেয়াল করেন না। তারপরও আমরা রোগীদের স্বার্থে কষ্ট করে যাচ্ছি। তাদের সেবার কাজে যেহেতু আল্লাহপাক আমাদের সুযোগটা করে দিয়েছেন, সদকায়ে জারিয়া হিসেবে যারা পরিশ্রম করছেন, আল্লাহ অবশ্যই তাদের ভালো রাখবেন এবং নিশ্চয়ই তারা ভালো থাকবেন। আমরা কোভিড, নন-কোভিড চিকিৎসা অব্যাহত রেখেছি, আশা করি অব্যাহত থাকবে।

একনজরে অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব, নতুন ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বিএসএমএমইউয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার খায়েরহাটে।

চোখের রোগের চিকিৎসা, প্রতিরোধসহ কমিউনিটি অফথালমোলজিতে অসামান্য অবদান রাখায় বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সার্ক একাডেমি অব অফথালমোলজির ১৪তম সম্মেলনে পিভিপি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। শারফুদ্দিন আহমেদ ১৯৫৬ সালের ৭ অক্টোবর গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার খারহাট গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম আলহাজ শামসুদ্দিন আহমেদ, মাতা হোসনে আরা বেগম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)

ব্যক্তিজীবনে তিনি তিন পুত্র সন্তানের জনক। বড় ছেলে ডা. তাজবীর আহমেদ (চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও পিএইচডি অধ্যয়নরত, টোকিও জাপান), মেজ ছেলে ডা. তানভীর আহমেদ (ঢাকা শিশু হাসপাতাল), ছোট ছেলে তাহমিদ আহমেদ সাদাত (প্রকৌশল ছাত্র), সহধর্মিনী ডা. নাফিজা আহমেদ, অধ্যাপক, ডার্মাটোলজি (অবসরপ্রাপ্ত), সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ। তিনি ১৯৮২ সালে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকুরীতে যোগ দেন। পরে সহকারী সার্জন, মেডিকেল অফিসার, রেজিস্ট্রার, রেসিডেন্ট সার্জন, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক (চক্ষু) হিসেবে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ২৪ মার্চ তিনি সহকারী অধ্যাপক (চক্ষু) হিসেবে তৎকালীন আইপিজিএমআর-এ যোগ দেন। ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান (২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত) এবং বর্তমানে কমিউনিটি অফথালমোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। ২০১৯ সালের ৪ জুলাই তিনি প্রথম গ্রেডপ্রাপ্ত হন। প্রায় ১০০টির মতো বিএমডিসি স্বীকৃত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রকাশনা রয়েছে তার (২০১৩-২০২১ সাল পর্যন্ত)। বাংলায় চক্ষুবিষয়ক তিনটি এবং ইংরেজিতে দুটি বইও রয়েছে।

তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রো-ভিসি (প্রশাসন), প্রথম ভিসি অধ্যাপক এম এ কাদেরীর সময় প্রথমে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি পরিচালক, হাসপাতাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাবলিক হেলথ ফ্যাকাল্টির ডিনের দায়িত্বও পালন করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক কাউন্সিলের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং অফথালমোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের পরপর তিনবার নির্বাচিত সভাপতি হিসাবে দায়িত্বপালন করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধা বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে তিনিও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৩ সালে সেন্ট্রাল স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের ইসি সদস্য। এক-এগারো পরবর্তী সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির লক্ষ্যে সকল আন্দোলন কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তৎকালীন সরকারের হয়রানির শিকারও হন অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।

টিআই/এমএআর/