চলবে না গণপরিবহন, তাই মতিঝিলে সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে মিডলাইন পরিবহনের বাসগুলো

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার সোমবার (৫ এপ্রিল) থেকে এক সপ্তাহের জন্য গণপরিবহন বন্ধসহ কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে। এতে কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ৭০ লাখ শ্রমিকের।

স্বাভাবিক সময়ে সড়ক ও মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন পরিবহন নেতারা। এ চাঁদা থেকে বিভিন্ন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের বাৎসরিক আয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। তারপরও করোনাকালে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান না পরিবহন নেতারা।

গত বছর সরকার পরিবহন, হোটেল ও নির্মাণশ্রমিকদের জন্য প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। নিয়োগপত্র না থাকায় পরিবহন খাতের প্রায় ৯৮ শতাংশ শ্রমিক সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে স্থানীয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের কাছ থেকে তাদের ছোট একটি অংশ চাল-ডাল সহায়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার এ ধরনের কোনো সহায়তারও আশ্বাস নেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরে চার হাজার কোটি টাকার যে চাঁদা তোলা হয় তার হিসাব বের করা যাবে। এর বাইরেও চাঁদা তোলা হয়। ওই হিসাব দেওয়ার মতো কেউ নেই। কারণ যে পরিবহন নেতারা এ চাঁদা তোলেন, তারা জবাবদিহিতার বাইরে। যার কারণে করোনাকালে দেশের ৭০ লাখ পরিবহনশ্রমিক আজ অসহায়।

কর্মস্থল খোলা, কিন্তু গণপরিবহন না ছাড়ায় ভোগান্তিতে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষ

গত বছরও করোনাকালে সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে বন্ধ ছিল গণপরিবহন। তখন হয়নি চাঁদাবাজি। তারপরও ওই বছর জুনে বিভিন্ন পরিবহন সংগঠন সমঝোতা করে ‘সড়ক পরিবহন সংগঠনের পরিচালনা ব্যয়/সার্ভিস চার্জ’ নামে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে। নির্দেশিকার ভূমিকায় অবশ্য এটাও বলা হয় যে, চাঁদাবাজি বন্ধে সংগঠনগুলো ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কিছু মাস্তান-সন্ত্রাসী, অমালিক, অশ্রমিকদের চাঁদাবাজির দায় সংগঠনকে নিতে হচ্ছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনও রয়েছে।

কিন্তু ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মোখলেসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের অর্থ গত বছরও শ্রমিকদের দিয়েছি। এবারও দেব। এখানে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে না।

করোনারোধে এবারও কার্যত সব বন্ধ হচ্ছে। আগের মতোই পরিবহন নেতারা শ্রমিকদের পাশে নেই। গাড়ি বন্ধ থাকলে খোরাকি দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সব জেলায় এবং সব শ্রমিক তা পাবেন কি না, এ নিয়ে শুরু থেকে সংশয়ে এ খাতের শ্রমিকরা।

মহাখালী টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পরিবহনশ্রমিকদের যতটুকু সম্ভব সহায়তা করে থাকি। তাদের খোরাকি দেওয়া হবে। দীর্ঘদিন গাড়ি বন্ধ থাকলে সরকারকেও শ্রমিকদের সহায়তা দিতে হবে।

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় খালি পড়ে থাকে ব্যস্ত এ সড়কগুলো  

খাতসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈধ-অবৈধ কমপক্ষে ৩০০ পরিবহন মালিক সমিতি ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন চাঁদাবাজি করে। এদের বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিবহন সংগঠন পরিচালনার ব্যয় ও শ্রমিকদের কল্যাণের নামে বছরে কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। দেশে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, ভারী যানবাহন, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের ভাড়ায় চালিত বাণিজ্যিক ১০ লাখ গাড়ি থেকে মালিক সমিতির জন্য গাড়িপ্রতি ৬০ টাকা এবং শ্রমিক ইউনিয়নের জন্য ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। সে হিসাবে দিনে কমপক্ষে ১১ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। বছরে যার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে তিন হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। আবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের জন্য দিনে প্রতি গাড়ি থেকে ১০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়।

পরিবহন খাতের অভিজ্ঞরা জানান, ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের কোটি টাকার বেশি ব্যবহার হচ্ছে না। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বিপুল অঙ্কের আর্থিক সুবিধাও শ্রমিকদের কাছে অধরা থেকে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন খাতে বেশুমার চাঁদাবাজির শুরু এরশাদ সরকারের সময় থেকে। পরে ২০০৯ সালে এই চাঁদার নাম দেওয়া হয় ‘সংগঠন পরিচালনা ব্যয়’। বাণিজ্যিক গাড়ি, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, পিকআপ, অটোরিকশা, ইজি বাইকসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন থেকে এ চাঁদা তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন বাস ছাড়ার আগে মালিক সমিতিকে ৬০ টাকা এবং শ্রমিক ইউনিয়নকে ৫০ টাকা দিতে হয়। পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের ৫০ টাকা থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনকে দিতে হয় ১০ টাকা।

গণপরিবহন না পেয়ে কেউ পিকআপ ভ্যানে অথবা ভ্যানে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্ট্যান্ড থেকে দিনে কমপক্ষে কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয় স্বাভাবিক সময়ে। এছাড়া ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে গেটপাসের (জিপি) নামে চাঁদা তোলা হয়। কেউ সড়কে নতুন বাস নামাতে চাইলে জেলা মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ঘুষ দিতে হয়। এসব অঘোষিত চাঁদার কোনো হিসাব নেই।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকন বলেন, কোনো কোম্পানির নামে বাস নামাতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। আমরা দেখেছি, বাস থেকে ৫০০ টাকা করে বিভিন্ন রুটে চাঁদা আদায় করা হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মোখলেসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৩ এপ্রিল আমরা ঢাকায় ফেডারেশনের জাতীয় সম্মেলন করেছি। সম্মেলনে পরিবহনশ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।

তবে পরিবহনের মালিকদের দাবি, তারা শ্রমিকদের নিয়মিত সহায়তা দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত বছর করোনাকালে গাড়ি বন্ধ থাকার সময় আমরা পরিবহন কোম্পানি থেকে শ্রমিকদের খোরাকি দিয়েছি।’

গণপরিবহন না চললেও সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়ায় প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য বাহন

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছর করোনাকালে আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলা হয়েছিল। এ চাঁদা বন্ধের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা পরিবহনশ্রমিকদের সহায়তা করেছি। পরিবহন খাত পরিচালনার জন্য বহু আগে থেকেই পরিচালনা ব্যয় তোলা হয়ে থাকে, এটা চাঁদাবাজি নয়।

তিনি আরও বলেন, সরকার আবারও গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা দাবি জানিয়েছি সীমিত আকারে গণপরিবহন চালু রাখার। জরুরি পণ্যপরিবহন চলবে, বইমেলা চলবে, গার্মেন্টস খোলা থাকবে কিন্তু যাত্রীপরিবহন কেন বন্ধ রাখা হবে— এটি আমাদের প্রশ্ন। যাত্রীপরিবহন বন্ধ রাখা হলে হাজার হাজার শ্রমিক অসহায় হয়ে পড়বেন।

সড়ক থেকে বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে তোলা অর্থ পরিবহনশ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হয়েছে দাবি করলেও গত বছর হন্য হয়েও সেই টাকা খুঁজে পাননি শ্রমিকরা। এমনকি লালমনিরহাট জেলা সদর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সামনে তারা বিক্ষোভও করেছিলেন।

ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বাসের চলাচল বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন একতা পরিবহনের চালক মো. বাবুল মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথম দিনে কিছু সহায়তা পাব বলে আশা করছি। কিন্তু একটি বাসের সব কর্মচারী সেটা পাবে না। চালক, সহকারী চালক ও সুপারভাইজার খোরাকি পাবেন। কিন্তু একটি পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও তিন/চারজন শ্রমিক কোনো সহায়তা পাবেন না।

সরকারি নির্দেশনা মেনে সড়কের ওপর অলস পড়ে আছে গণপরিবহনগুলো

মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম অবশ্য বলেন, সব পরিবহন শ্রমিককে খোরাকি দিতে মালিকরা পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ অবস্থা যদি দীর্ঘদিন চলে তাহলে সরকারকে সহায়তা দিতে হবে। দেশে বইমেলা চলছে, বাজার বন্ধ হয়নি, জরুরি পণ্যপরিবহন চলছে; সেক্ষেত্রে যাত্রীপরিবহনও সীমিতভাবে চালানো উচিত। তাহলে শ্রমিকরা বিপদে পড়তেন না।

সোমবার দুপুরে সরেজমিনে মিরপুর ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন সড়কে রাখা হয়েছে সারি সারি বাস। মিরপুর-১২ নম্বরে বিআরটিসি বাস ডিপোর কাছে কথা হয় শিকড় পরিবহনের চালক মো. সোহেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, গাড়ি চালানো বন্ধ। সাতদিন কীভাবে চলব, কী সহায়তা পাব জানি না।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচল করে সাড়ে তিন হাজার বাস। সোমবার থেকে সেগুলোর চলাচলও বন্ধ। চালকদের একটি অংশ বিভিন্ন জেলায় গাড়ি নিয়ে অবস্থান করছেন। ঢাকা জেলা সড়ক সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এ টার্মিনালের ৫০ শতাংশ চালক বিভিন্ন জেলায় অবস্থান করছেন। আজ তারা খোরাকি পাননি, আগামীকাল পাবেন বলে আশা করছি।’ কারা দেবেন— প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘খোরাকি মালিকরা দেবেন।’

এদিকে বাংলাদেশ অটোরিকশা হালকা যান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক বলেন, সরকার শ্রমিকদের পরিবারের কথা চিন্তা না করে গণপরিবহনের চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিবহনের চাকা বন্ধ হলে, তাদের সংসারের চাকাও বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর করোনাকালে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা যে ধারদেনা করেছিল সেটা আজও তারা পরিশোধ করতে পারেননি। আমরা সরকারের কথা মতো শ্রমিকদের তালিকা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

পিএসডি/এমএইচএস/এমএআর