মোহাম্মদ এ আরাফাত, একজন শিক্ষাবিদ; যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০০৫ সালে দেশে ফিরে আসেন। জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এমন নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। তখনও আরাফাত নামটি সবার কাছে পরিচিতি পায়নি। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচিতি বাড়লেও রাজনীতির মাঠে কখনও নামবেন, তা হয়তো অনেকে চিন্তা করেননি। তবে, সামাজিক কর্মকাণ্ডের ফাঁকে ফাঁকে এ শিক্ষাবিদ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ার দিকে।

২০২৩ সালের ১৫ মে ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নায়ক ফারুকের মৃত্যুর পর ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে নৌকার মাঝি হিসেবে প্রথমে নাম ওঠে মোহাম্মদ আলী আরাফাতের। ওই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন তিনি। সাড়ে চার মাসের জন্য এমপি হয়ে দলীয় হাই-কমান্ডের সন্তুষ্টির বদৌলতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও মনোনয়ন পান তিনি।

বনানী-গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় নির্বাচনী প্রচার ও প্রচারণার কৌশল, উন্নয়নের ধারা ধরে রাখা, বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা, বিশেষ করে এ আসনের নিম্নবিত্তের জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন ঢাকা পোস্টের কাছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মনি আচার্য্য ও মুছা মল্লিক।

ঢাকা পোস্ট : খুব অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের প্রচারণায় নামলেন। ভোটারদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : প্রায় প্রতিদিনই প্রচারণায় নামছি। ঢাকা-১৭ আসনের অধিকাংশ এলাকা ইতোমধ্যে আমি কাভার করেছি। শেষ দিন পর্যন্ত প্রচারণা চলবে। প্রচারণার জন্য যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। বিশেষ করে তৃণমূলের মানুষদের কাছ থেকে।

ঢাকা পোস্ট :  ঢাকা-১৭ আসনে আপনি ছাড়া আর কোনো হেভিওয়েট প্রার্থী নেই। বিশেষ করে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির কোনো প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে নেই। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে কি না?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : আমরা তো সবাইকে বলেছি নির্বাচনে আসতে। নির্বাচনটা একটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তাই নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন হচ্ছে। সবার এতে অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল। যারা কোনো ধরনে ঝুঁকি নিতে চাইনি তারা আগে থেকেই নির্বাচন বর্জন করেছেন। তারা আসলে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি। প্রতিযোগিতা করে আপনি হারতে কিংবা জিততে পারেন। তবে, যারা আগে থেকে অনুমান করেছে যে তারা জিততে পারবেন না, তারা বর্জন করেছেন। এটা আসলে তাদের ব্যাপার।

প্রতিপক্ষ কে, আমরা এটা চিন্তা করে নির্বাচন করি না। বিশেষ করে ঢাকা-১৭ আসনে নৌকার এত ভোটার আছে যে, আমাদের ভোটারদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে যে রাজনীতি বা ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, সেটাতে ফোকাস দেওয়া হচ্ছে। আমরা জানি, ঢাকা-১৭ আসনে নৌকার প্রচুর ভোটার। ভোটগুলো ব্যালটের মাধ্যমে আনতে পারলে আমাদের জয় সুনিশ্চিত।

ঢাকা পোস্ট : বিএনপি ছাড়া নির্বাচন কি আসলেই গ্রহণযোগ্য হবে, আপনি কী মনে করেন?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : বিএনপিকে নির্বাচনে আনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নয়। আওয়ামী লীগ নিজে একটা রাজনৈতিক দল। সবার নির্বাচনে আসার কথা। তাই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এসেছে। নির্বাচনে যারা আসেননি সেটা তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত। যারা আসেননি তাদের দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারি না। এ কারণে কেউ যদি ভাবেন নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, সেই ভাবনার বিষয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। এ ভাবনার সঙ্গে যুক্তি কিংবা আইনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

ঢাকা পোস্ট : ঢাকা-১৭ আসনের নির্বাচন কি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, নাকি একতরফা হবে?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : এখানে যারাই দাঁড়াক না কেন, নৌকার প্রার্থীর নির্বাচন একতরফাই হবে। কারণ, এ আসনে নৌকার ভোট অনেক বেশি, অন্য যে কোনো প্রার্থীর তুলনায়। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নৌকার ভোটগুলো ব্যালটে নিয়ে আসা। আরেকটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ঢাকা-১৭ আসনে ভোট আছে তিন লাখ ১৮ হাজার। এটা কিন্তু সঠিক সংখ্যা নয়। মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ এখানে নেই, তারা মাইগ্রেট করে অন্যত্র চলে গেছে। তিন লাখ ১৮ হাজারের জাগায় ভোটার আছে দুই লাখের মতো। এ কারণে শতাংশের হিসাবে ভোট কাস্টিং কিছুটা কম হয়ে যাবে।

আমার উপ-নির্বাচনে বলা হয়েছিল, সাড়ে ১১ শতাংশ ভোট পড়েছে। সেটা হিসাব করা হয়েছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ভোটার ধরে। কিন্তু আসলে ভোট পড়েছিল ২২ শতাংশের মতো। যারা এলাকার বাইরে আছেন, তাদের তো আনা যাবে না। ভোটারদের মাইগ্রেশন সমস্যা ঢাকা-১৭ আসনে একটু বেশি প্রকট।

ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ঢাকা-১৭ আসন থেকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এতে আপনার নির্বাচনী হিসাবটা আরও সহজ হলো কি না?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : জি এম কাদের কিংবা যে-ই হোক না কেন, যারা ঢাকা-১৭ আসনে নির্বাচন করতে চেয়েছেন, আমি সবাইকে স্বাগত জানিয়েছি। কারও চলে যাওয়া আমি কখনও ইতিবাচক হিসেবে দেখি না। যারা নির্বাচন করছেন এবং নির্বাচনের মধ্যে থাকবেন, তাদের আমি স্বাগত জানাই।

মোহাম্মদ এ আরাফাতের সঙ্গে কথা বলছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মনি আচার্য্য / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে অল্প সময়ের জন্য এমপি হয়েছেন। এমন কিছু করেছেন কী, যা দেখে ভোটাররা আবারও আপনার ওপর আস্থা রাখবেন?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : আমি আসলে সাড়ে চার মাস সময় পেয়েছি। এ সময়ের মধ্যে কী করা যায়, আপনিই বলেন? উপ-নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে আমার। এর মাধ্যমে আমি তাদের চাহিদা, সমস্যা ও প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে পেরেছি। কিছু কিছু সমস্যা আমি সমাধান করার চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু আছে, যেগুলো প্রক্রিয়াধীন। বড় আকারে বলতে গেলে, আমি যদি ফের নির্বাচিত হই তাহলে জানি আমাকে আগামী পাঁচ বছরে কী করতে হবে। এ ভিতটা তৈরি হয়ে গেছে উপ-নির্বাচনের পর। ফলে, আগামী পাঁচ বছরের জন্য আমি পরিকল্পনা করে ফেলেছি।

১৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে মাটিকাটা, ভাসানটেকসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের প্রয়োজন। পানি ও রাস্তাঘাটের কিছু সমস্যা আছে। আগামী পাঁচ বছরে এসব সমস্যার সমাধান করব, যদি নির্বাচিত হই।

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচিত হলে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা আছে কি না?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : আমি ২০০৫ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসি। এর আগে আমি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম, সেখানে পড়াশোনা করেছি। আমি কোনো পদে থাকব, উপরে না নিচে— এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। আমি সব সময় মনে করেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশটা দাঁড়াক। একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজ হতে হবে বাংলাদেশে। এ ছাড়া, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার জন্য যে নেতৃত্ব সবচেয়ে শক্তিশালী, তার পাশে থাকতে হবে। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে সব সময় আমি সহযোগিতা করে এসেছি। সেটা এখনও করে যাব। আমি পদ নিয়ে ভাবি না। নিয়ত যদি ঠিক থাকে তাহলে যে কোনো জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দেওয়া সম্ভব।

মোহাম্মদ এ আরাফাতের সঙ্গে কথা বলছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুসা মল্লিক / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : ঢাকা-১৭ আসেন নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ভোটার রয়েছেন। দুই শ্রেণির ভোটারদের টানতে আপনার পরিকল্পনা কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : উচ্চবিত্ত ভোটারদের টানার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। উচ্চবিত্ত ভোটার যারা আছেন, তারা ভোটের বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। তারা আসলে যেখানে থাকেন সেখানে (গুলশান) নতুন করে কিছু করার নেই। তারা বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। তারা তাদের মতো করে ভালো আছেন।

আমার সীমাবদ্ধ যে সম্পদ, সুযোগ ও ক্ষমতা, তার সর্বোচ্চটা দিয়ে আমি নিম্নবিত্ত, গরীব ও বস্তিবাসীদের পাশে দাঁড়াব। এটা আমার প্রথম অগ্রাধিকার। আমি ঘোষণা দিয়েই এটা বলেছি। তবে, বনানী ও গুলশানে যারা থাকেন, তাদের এসে ভোট দেওয়া উচিত। সবারই নাগরিক দায়িত্ব পালন করা উচিত।

ঢাকা পোস্ট : নিম্নবিত্তদের জন্য কিছু করার কথা বলছেন। একটু ব্যাখ্যা করতেন যদি...

মোহাম্মদ এ আরাফাত : বিগত দিনের তুলনায় আরেকটু ভালো জীবনযাপন যেন তারা (ঢাকা-১৭ আসনের ভোটাররা) করতে পারেন, নির্বাচিত হলে আমি সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেব। কর্মসংস্থানের একটু বেশি সুযোগ তৈরি করব। এখানে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা একটু বেশি, এগুলোর সমাধান করব। রাস্তাঘাটের আরও উন্নয়ন করতে হবে, সেটা করব। ঢাকা-১৭ আসন হলো নৌকার ঘাঁটি। এখানে যে-ই দাঁড়াক না কেন জয় হবে শুধু নৌকার।

ঢাকা পোস্ট : ভোটারদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : সবাই ভোট দেবেন, অনেক ভোট দিতে হবে। অপশক্তিকে জবাব দিতে হবে ভোটের মাধ্যমে।

ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। এখন রাজনীতির মাঠে। নতুন এ যাত্রাপথ নিয়ে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মোহাম্মদ এ আরাফাত : আমার কাছে রাজনীতির মাঠ কিন্তু নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এ পথে আছি, আমার মতো করে। ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের আনাচে–কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের জন্য ইয়াং জেনারেশন রিক্রুট করা, তাদের অর্গানাইজ করার কাজ করেছি। জঙ্গিবাদের উত্থান এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় মাদ্রাসাগুলোতে গিয়েছি। বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে তাদের (মাদ্রাসা) কমিউনিটির সঙ্গে টানা পাঁচ বছর কাজ করেছি। এমন মৌলিক জায়গাগুলোতে আমি সব সময় কাজ করেছি।

আমি নীরবে কাজ করার মানুষ। কখনও ক্যামেরা নিয়ে ঘুরিনি, ছবি তুলে পোস্ট দিইনি। রাজনীতি ও শিক্ষকতা— দুটোকেই আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

এমএসি/এমএম/এমএআর/