গরুর মাংসের দাম নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি, এ সুযোগে দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা

ঈদের দিন সকালে মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের বাজারে গরুর মাংস কিনতে যান বেসরকারি চাকরিজীবী মো. নাজমুল হুসাইন। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা হওয়ার পরও গরুর মাংস কিনতে ‘গায়ে লাগছে’ বলে জানান। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘সাড়ে পাঁচশ টাকার গরুর মাংস কীভাবে সাড়ে ছয়শ টাকা কেজি হয়ে যায়।’ শুধু নাজমুলের একার প্রশ্ন নয়, অনেকেই তুলেছেন এমন প্রশ্ন!

বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান বা ঈদ উপলক্ষে পণ্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র একেবারে উল্টো। মনের ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে নাজমুল বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতিসহ কোনোকিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। শুধু সাধারণ মানুষেরই পকেট কাটা হয়।’

• এবারের ঈদে হয়েছে ৮-১০ হাজার গরু জবাই
• গত ২ বছরে মন্ত্রণালয়ের কোনো মিটিং হয়নি
• ভারতীয় মাংসে সয়লাব দেশের বাজার
• শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভারত
• রফতানির এ খাতকে ধ্বংস করছেন সংশ্লিষ্টরা

গরুর মাংসের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব মো. রবিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মাংসের দাম নির্ধারণে একাধিকবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনকে বললেও তারা কর্ণপাত করেনি। রফতানিযোগ্য বিশাল এ খাতকে প্রতিনিয়তই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।’

তিনি বলেন, ‘এবারের ঈদুল ফিতরে রাজধানীতে আনুমানিক আট থেকে ১০ হাজার গরু জবাই হয়েছে। ২৭ রমজান থেকে ঈদের দিন পর্যন্ত গরুগুলো জবাই হয়। তবে গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা কম। গত বছর আনুমানিক ১২ থেকে ১৩ হাজার গরু জবাই হয়।’

মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘করোনার বিস্তার রোধে সরকারের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে দেশের সার্বিক অবস্থা খারাপ, ঢাকায় লোকজন কম, মাংসের চাহিদাও কম। এসব কারণে গরু জবাইয়ের সংখ্যা কমেছে। এছাড়া ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ মাংস পাচার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে আমদানি হচ্ছে ভারতীয় মাংস। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও দেশের ক্ষতি হচ্ছে।’

কীভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু মাংস খাওয়ার জন্য গরু জবাই করি না। মাংস ছাড়াও পশুর হাড়, ভুঁড়ি, চামড়াও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো শত কোটি টাকার রফতানিযোগ্য পণ্য। সেই রফতানিযোগ্য পণ্য ভারত নিজের কাছে রেখে শুধু মাংসটা আমাদের দেশে পাঠায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি গরুর দাম যদি লাখ টাকা হয়, তবে মাংস ছাড়া পশুর অন্যান্য উপাদান বিদেশে রফতানি করে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা আয় করা যায়। বিষয়টি ভারতীয় সরকার অবগত হওয়ার পরই জীবিত গরু বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। শুধু মাংস রফতানি করে শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে লুটে নিচ্ছে ভারত। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে চোরাকারবারিরা উৎসাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পাচারকারীরা বর্তমানে এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ, দেশে মাংস রফতানির সরকারি কোনো অনুমতি নেই।’

ঢাকা সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মাংসের মূল্য নির্ধারণে কেন নিরুৎসাহিত হচ্ছে, এর পেছনের কারণ কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর আগে তোফায়েল আহমেদ যখন বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমি ভারত থেকে আসা মাংসের বিষয়ে প্রস্তাব করেছিলাম। ওই সময় তোফায়েল আহমেদ এটা নিষিদ্ধ করেছিলেন। বর্তমানে যিনি মন্ত্রী আছেন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, তারা বিগত দুই বছর আমাদের নিয়ে কোনো মিটিং করার প্রয়োজন মনে করেননি। ঢাকা সিটি করপোরেশনও কোনো মিটিং করেনি। সবাই যেন এ খাতটা নিয়ে একটা গাছাড়া ভাব দেখাচ্ছেন। তাদের কাছে গেলে মনে হয়, তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। তারা যেন সবাই আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে বাঁচতে চান। বাঁচার পরও যে কিছু দায়িত্ব আছে, দেশ বাঁচাতে হবে— এ কথাটা কারও মনে আসে না। আমি আর মিডিয়া মিলে কী করব? বারবার বলার পরও যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের কাছে আমাদের কথা পৌঁছায় না।’

অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে রবিউল আলম বলেন, ‘সারাবিশ্বে ঈদের সময় পণ্যের দাম কমে বা ব্যবসায়ীরা ভর্তুকি দেন। আমাদের দেশে এর উল্টো পরিস্থিতি দেখা যায়। সরকার সাধারণ জনগণের গলা কাটার ব্যবস্থা করেছে। কোরবানির ঈদে গরুর খাজনা শতকরা ৫ টাকা। কিন্তু সারাবছর তা ৩ টাকার মধ্যে থাকে। আমার প্রশ্ন, সরকার এ কাজটা কেন করছে। সিটি মেয়রদের কানে হাজারবার এটা দেওয়ার পরও তাদের মাথায় সেটা আসে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গরুর হাটগুলো মাফিয়া ডনরা নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ১০ কোটি টাকায় হাট ইজারা নিয়ে ১০০ কোটি টাকার বেশি খাজনা আদায় করে। ঢাকা শহরে প্রতি বছর ৫ লাখ পশু কোরবানি হয়, এটা কি তাদের মাথার ভেতরে নাই? আড়াই হাজার টাকা খাজনা হলে কত টাকা হয়? অথচ সেই গরুর হাট ৫ কোটি, ৯ কোটি বা ১০ কোটি টাকায় ইজারা হয় কীভাবে? বাকি টাকা কারা খায়?’
 
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘কোনো একটি আলোচনা বা মিটিংয়ের ব্যবস্থা নাই। কসাই বা মাংস ব্যবসায়ী বলে আমাদের অনেকে ছোট করে দেখেন। দেশের অর্থনীতি এখন মাংস ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করে। গার্মেন্টস এক নম্বর রফতানি খাত হলেও দ্বিতীয় খাত হিসেবে রয়েছে পশুর বর্জ্য ও চামড়া। বিষয়টি আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের মাথায় আসে না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার দোহাই দিয়ে গত দুই বছরে মাংস রফতানি বা চামড়া শিল্প নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো মিটিং হয়নি। মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় ভারতীয় মাংস দেশের বাজারে সয়লাব হচ্ছে। এদিকে, কাঁচামালের অভাবে রফতানিযোগ্য পণ্য পশুর বর্জ্য ও চামড়া শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।’

অতিরিক্ত দাম হওয়া সত্ত্বেও গরুর মাংস কিনতে দোকানে মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়

এবারের ঈদে গরুর মাংস কেন সাড়ে ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতি রমজানে ক্রেতাদের স্বার্থে মাংসের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ভার্চুয়ালি মিটিং করার পরও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি কেন? মাংসের দাম নির্ধারণ না করে গাবতলীর মাফিয়া ডন এবং যারা মাংস ও চামড়া পাচারে নিয়োজিত, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ক্রেতাসাধারণকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আমাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি মিটিং করেছে। মিটিংয়ের পরের দিন তাদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা ছিল। আমি ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছি। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেননি। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিটিংয়ের তারিখ দেওয়ার পর করোনার কারণে তা স্থগিত করে দেয়। কিন্তু তারা চাইলে ভার্চুয়াল মিটিং করতে পারত। এটা তারা করেনি। এভাবেই তারা গাফিলতি করেছে। এ সুযোগে বেড়েছে মাংসের দামও।’

এসআর/আরএইচ/এমএআর