নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগে দীর্ঘদিনের সমালোচিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ অবশেষে বাতিল করেছে সরকার। এ আইনের পরিবর্তে নতুনভাবে জারি করা হয়েছে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন এ অধ্যাদেশে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সাইবার অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ ও সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি ব্যক্তির গোপনীয়তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষার ওপর। পাশাপাশি অনলাইন জুয়া, হ্যাকিং, প্রতারণা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ, কিছু ক্ষেত্রে রাখা হয়েছে লঘু দণ্ডের বিধান।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নাগরিকদের ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাইবার স্পেসে সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ ও বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও সুসংগঠিত করবে। এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তির গোপনীয়তা ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার রক্ষায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনেকে আশঙ্কা করছেন, আইনটির কিছু অস্পষ্ট ধারা ভবিষ্যতে ভুল প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ফলে কার্যকর প্রয়োগ, স্বচ্ছ ব্যাখ্যা ও জবাবদিহিমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে এ অধ্যাদেশের সফলতার মূল চাবিকাঠি।

পূর্ববর্তী আইনের সীমাবদ্ধতায় এসেছে নতুন অধ্যাদেশ

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ প্রণয়নকাল থেকে নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। অনেকের আশঙ্কা ছিল, আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং এর বেশকিছু ধারা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করে। ফলশ্রুতিতে প্রণয়ন করা হয় ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’।

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ রহিত হলেও, পূর্ববর্তী আইনের অধীনে দায়ের করা কিছু গুরুতর অপরাধের মামলা (১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ৩০, ৩২, ৩৫ ধারা) নতুন অধ্যাদেশের আওতায় আসবে না। বরং পুরোনো আইনেই তার বিচার ও নিষ্পত্তি হবে। তবে, অন্যান্য বেশকিছু ধারার (২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪ ধারা) অধীনে চলমান সব মামলা ও কার্যক্রম বাতিল হয়ে যাবে এবং সংশ্লিষ্ট দণ্ড ও জরিমানাও বাতিল বলে গণ্য হবে

নতুন এ অধ্যাদেশে নাগরিক সুরক্ষা, ব্যক্তি গোপনীয়তা ও ডিজিটাল অধিকারের বিষয়গুলোকে আরও স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু সাইবার অপরাধ দমনই নয় বরং এটি ডিজিটাল পরিসরে নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তার একটি ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো গড়ে তোলার দিকেও অগ্রসর হয়েছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

গত বছর পটপরিবর্তনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়ন করে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

পুরোনো আইনেই শেষ হবে কিছু পুরোনো মামলার বিচার

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ রহিত হলেও, পূর্ববর্তী আইনের অধীনে দায়ের করা কিছু গুরুতর অপরাধের মামলা (১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২২, ২৩, ৩০, ৩২, ৩৫ ধারা) নতুন অধ্যাদেশের আওতায় আসবে না। বরং পুরোনো আইনেই তার বিচার ও নিষ্পত্তি হবে। তবে, অন্যান্য বেশকিছু ধারার (২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪ ধারা) অধীনে চলমান সব মামলা ও কার্যক্রম বাতিল হয়ে যাবে এবং সংশ্লিষ্ট দণ্ড ও জরিমানাও বাতিল বলে গণ্য হবে।

সাইবার অপরাধের লাগাম টানতে গঠন করা হবে জাতীয় কাউন্সিল

দেশের ক্রমবর্ধমান সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে শক্তিশালী ‘জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল’। নতুন অধ্যাদেশের আলোকে গঠিত এ কাউন্সিল হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী ও নির্দেশনামূলক প্ল্যাটফর্ম। যার চেয়ারম্যান থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা, গোয়েন্দা, টেলিযোগাযোগ, রাজস্ব, বিচার বিভাগীয় ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা থাকবেন এ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে।

তাদের মধ্যে রয়েছেন— ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিটিআরসি চেয়ারম্যান, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারক (প্রধান বিচারপতির মনোনীত), জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, তথ্য কমিশনের সচিব, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান এবং সরকার মনোনীত তথ্যপ্রযুক্তি বা মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট দুজন বেসরকারি বিশেষজ্ঞ। কাউন্সিলের কার্যক্রমে সচিবালয় বা দাপ্তরিক সহায়তা প্রদান করবেন জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সির মহাপরিচালক।

দেশের ক্রমবর্ধমান সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে শক্তিশালী ‘জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল’। নতুন অধ্যাদেশের আলোকে গঠিত এ কাউন্সিল হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী ও নির্দেশনামূলক প্ল্যাটফর্ম। যার চেয়ারম্যান থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা, গোয়েন্দা, টেলিযোগাযোগ, রাজস্ব, বিচার বিভাগীয় ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানরা থাকবেন এ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে

এ কাউন্সিলের মূল দায়িত্ব হবে— দেশের সার্বিক সাইবার নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ঝুঁকি মোকাবিলায় দিকনির্দেশনা প্রদান। তারা সাইবার নিরাপত্তা অবকাঠামোর উন্নয়ন, দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক নীতিনির্ধারণ, সাইবার আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাসহ বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য কার্যসম্পাদন করবেন। কাউন্সিল প্রতি তিন মাস অন্তর একটি বৈঠক করবে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে চেয়ারম্যান চাইলে যেকোনো সময় সভা আহ্বান করা যাবে। সভায় প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্ব করবেন এবং তার অনুপস্থিতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা উপদেষ্টা সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগে সমালোচিত ছিল ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ / ছবি- সংগৃহীত

অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কাউন্সিল প্রতি তিন মাস অন্তর দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো, সরকারি-বেসরকারি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সাইবার ঝুঁকি নিরীক্ষা করাবে। কম্পিউটার ইন্সিডেন্ট রেসপন্স টিমের (সিআইআরটি) তৈরি করা রিপোর্ট কাউন্সিল মূল্যায়ন করবে। কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ জনগণের স্বার্থে গণমাধ্যম ও সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার কথাও বলা হয়েছে।

নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে ‘ডিজিটাল’ ও ‘সাইবার স্পেস’-এর সংজ্ঞাকে অত্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে। এতে নতুন করে স্থান পেয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং আধুনিক প্রযুক্তিগত অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম। ফলে ভবিষ্যতে উদ্ভূত যেকোনো নতুন সাইবার হুমকি মোকাবিলা করা সহজ হবে।

হবে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব, জোর দেওয়া হবে শিশু সুরক্ষায়

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ প্রথমবারের মতো ‘ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব’ গঠনের সুস্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এটি এমন ল্যাব হবে যেখানে অনুমোদিত ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিচালিত পরীক্ষাগার, যা ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও আদালতে উপস্থাপনে বিশেষ কারিগরি সক্ষমতা থাকবে। এছাড়া এর মাধ্যমে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলায় প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা এবং তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়বে।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ প্রথমবারের মতো ‘ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব’ গঠনের সুস্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, এটি এমন ল্যাব হবে যেখানে অনুমোদিত ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিচালিত পরীক্ষাগার, যা ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও আদালতে উপস্থাপনে বিশেষ কারিগরি সক্ষমতা থাকবে। এছাড়া এর মাধ্যমে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলায় প্রমাণের গ্রহণযোগ্যতা এবং তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়বে

অধ্যাদেশে স্থান পেয়েছে শিশুর যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত ডিজিটাল উপাদানের ব্যাপারও। এতে বলা হয়েছে, কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তৈরি বা প্রদর্শিত এমন সব উপাদান যা শিশুকে যৌন নির্যাতন, যৌন শোষণ, যৌন সেবা বা যৌনতাপূর্ণ কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে প্ররোচিত করে বা সহযোগিতা করে, তা কঠোরভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বাস্তব কিংবা অনুকৃত যৌন কার্যকলাপের ছবি, ভিডিও, অডিও বা লেখা, শিশুকে যৌন কাজে জড়ানোর জন্য প্ররোচনা বা উৎসাহ দেওয়া— সবই আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ রহিত হলেও, পূর্ববর্তী আইনের অধীনে দায়ের করা কিছু মামলা নতুন অধ্যাদেশের আওতায় আসবে না / ছবি- সংগৃহীত

সাইবার জগতে যৌন হয়রানি ও ‘রিভেঞ্জ পর্ন’ ঠেকাতে কঠোর শাস্তির বিধান

সাইবার জগতে নারীদের সম্মানহানি, ছবি বিকৃতি এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার চরম লঙ্ঘন— সবকিছুর বিরুদ্ধে এবার কড়া পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। সদ্য জারি হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী নগ্ন ছবি চাওয়া, বিকৃতি করা বা অনুমতি ছাড়া ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অনলাইন অপরাধগুলোকে সরাসরি যৌন হয়রানি ও রিভেঞ্জ পর্ন হিসেবে চিহ্নিত করে দণ্ডনীয় করা হয়েছে।

নতুন আইনে বলা হয়েছে, বারবার নগ্ন ছবি চাওয়া, শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেওয়া, যৌনাঙ্গের ছবি বা পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পাঠানো, এমনকি কারও অনুমতি ছাড়া তার ছবিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে বিকৃত করে যৌন উদ্দীপক উপাদানে রূপান্তর করা— সবই এখন স্পষ্টত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

এছাড়া ‘রিভেঞ্জ পর্ন’ বা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কারও অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া, ভিডিও এডিট করে পর্নোগ্রাফিতে রূপান্তর করা, কিংবা গোপনে ধারণ করে তা প্রকাশ করা— এসব কাজকেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অধ্যাদেশ নারীদের জন্য একটি যুগান্তকারী সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করেছে। কারণ, অনলাইনে হয়রানির ভয়ে অনেকে মুখ খুলতেন না বা আইনি পদক্ষেপ নিতে সাহস পেতেন না। এখন স্পষ্ট আইনি সংজ্ঞা থাকায় তারা সুরক্ষা পাবেন এবং অপরাধীরা আর সহজে পার পাবেন না। এ আইন অনুযায়ী প্রযুক্তির অপব্যবহার করে যৌন হয়রানি ও সম্মানহানির যেকোনো চেষ্টাকে দ্রুত শনাক্ত ও দমন করতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব ও সাইবার রেসপন্স টিম কাজ করবে।

ডিজিটাল মাধ্যমে যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং বা অশ্লীল কনটেন্ট ছড়িয়ে নারীদের হেনস্তা কিংবা শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫-এ। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইলিং, যৌন হয়রানি, রিভেঞ্জ পর্ন, ডিজিটাল শিশু যৌন নিপীড়ন বা সেক্সটর্শনের উদ্দেশ্যে কোনো ভিডিও, অডিও, স্থিরচিত্র বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা নির্মিত কোনো অশ্লীল বা ভীতিকর তথ্য প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন কিংবা এমন হুমকি দেন, তাহলে তা হবে অপরাধ

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নারীদের যৌন হয়রানি, মানসিক নিপীড়ন ও সম্মানহানির মতো ভয়াবহ অপরাধগুলো এতদিন আইনগতভাবে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ছিল না। ফলে ভুক্তভোগীরা যথাযথ সহায়তা পেতেন না। অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতেন না বা আইনের দ্বারস্থ হতেও সংকোচ বোধ করতেন। কিন্তু নতুন আইন নারীর সুরক্ষায় একটি যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করেছে। এছাড়া রিভেঞ্জ পর্ন, বিকৃত ছবি ছড়ানো বা অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্ট পাঠানোর মতো অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে এবার সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আইনটি প্রযুক্তি-নির্ভর অপরাধ শনাক্ত ও প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ভূমিকা আরও শক্তিশালী করবে। এটি একটি সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ, যা দেশের নারীদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছি।’

দেশের ক্রমবর্ধমান সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে শক্তিশালী ‘জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল’ / ছবি- সংগৃহীত

হুমকি মনে হলে করা যাবে কনটেন্ট ব্লক বা অপসারণ

সাইবার জগতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা কিংবা ধর্মীয় সহনশীলতার হুমকি তৈরি হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখন তাৎক্ষণিকভাবে কনটেন্ট অপসারণ বা ব্লক করতে পারবে।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো কনটেন্ট যদি দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা বা জনশৃঙ্খলা নষ্ট করে বা সহিংসতার আশঙ্কা সৃষ্টি করে, তাহলে সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবে। প্রয়োজন অনুসারে কনটেন্ট অপসারণ, স্থানান্তর অথবা ব্লক করতে পারবে কিংবা বিটিআরসিকে অনুরোধ জানাতে পারবে।

তবে, এর পেছনে যেন স্বেচ্ছাচারিতা বা অনিয়ম না ঘটে, সেজন্য তিনদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি না মিললে কনটেন্ট পুনরায় অনলাইনে ফিরিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।

অধ্যাদেশের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সিইআরটি) গঠন করা হবে, যা এজেন্সির অধীনে কাজ করবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোর জন্য আলাদা রেসপন্স টিম ও সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার থাকবে, যাদের প্রতি তিন মাসে কার্যক্রমের রিপোর্ট দিতে হবে। রেসপন্স টিমে থাকবেন সাইবার সুরক্ষা ও ডিজিটাল ফরেনসিক বিষয়ে সনদপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ, আইটি বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। এছাড়া সরকার সব ধরনের ব্লক করা কনটেন্টের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ প্রথমবারের মতো ‘ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব’ গঠনের সুস্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে / ছবি- সংগৃহীত

হ্যাকিংয়ে জড়ালে সর্বোচ্চ ৫ বছরের জেল, ৫০ লাখ টাকা জরিমানা

নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে হ্যাকিং বা বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে এখন থেকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে কেউ যদি কোনো কম্পিউটার সিস্টেম, সার্ভার, সাইবার স্পেস বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভান্ডারে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, কিংবা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোনো তথ্য চুরি, নষ্ট, পরিবর্তন বা মূল্যহ্রাস করেন, তাহলে সেটি হবে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমন অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

এছাড়া কেউ যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) টুলস ব্যবহার করে বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে নতুন কোনো ডাটা তৈরি করেন বা ক্ষতিসাধনের মতো কার্যক্রমে যুক্ত থাকেন, কিংবা এমন কাজে অন্যকে সহায়তা করেন, তাহলেও তাকে একইভাবে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আইনটি শুধু হ্যাকার বা অপরাধী নয়, বরং সফটওয়্যার ডেভেলপার ও এআই ব্যবহারকারী যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হবে।

আইনে আরও বলা হয়েছে, কেউ যদি সাধারণ কম্পিউটার সিস্টেম, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা সার্ভারে বেআইনিভাবে প্রবেশ করেন এবং তা কোনো অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলে তাকে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা, কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। যেহেতু হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কোনো তথ্য চুরি, পরিবর্তন বা বিনাশের মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়, তাই এর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নতুন অধ্যাদেশে ডিজিটাল মাধ্যমে যৌন হয়রানি, অশ্লীল কনটেন্ট ছড়িয়ে নারীদের হেনস্তা কিংবা শিশু নির্যাতনের ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে / ছবি- সংগৃহীত

ডিজিটাল জুয়া, প্রতারণা ও সাইবার সন্ত্রাস রুখতে কঠোর শাস্তির বিধান

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনলাইন জুয়া, প্রতারণা, জালিয়াতি, সাইবার সন্ত্রাস এবং আইনবহির্ভূত ই-লেনদেনকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে এ আইনে দোষীদের জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

অধ্যাদেশ অনুযায়ী সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার জন্য অ্যাপস, পোর্টাল বা যেকোনো মাধ্যম তৈরি বা পরিচালনা, এতে অংশগ্রহণ কিংবা বিজ্ঞাপন প্রচারও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে অনলাইনে জালিয়াতির মাধ্যমে তথ্য পরিবর্তন, মুছা, বিকৃতি, ডিজিটাল মানি উৎপাদন কিংবা ভুয়া সিম ব্যবহার করে হুন্ডি বা মোবাইল ব্যাংকিং চালানোও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

অন্যদিকে, সাইবার প্রতারণার শাস্তি আরও বেশি। ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজিটাল ডিভাইস, নেটওয়ার্ক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা ই-কমার্সে তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা আদায় বা ক্ষতির চেষ্টা করলে তা হবে প্রতারণা। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধগুলোর একটি হলো সাইবার সন্ত্রাস। কোনো ব্যক্তি যদি কম্পিউটার সিস্টেম, ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে বেআইনিভাবে প্রবেশ, ম্যালওয়্যার প্রবেশ, প্রয়োজনীয় দ্রব্য বা সেবার সরবরাহ ব্যাহত করা বা সংরক্ষিত ডেটাবেইজ ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী বা জনশৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তাহলে তা সাইবার সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এছাড়া আইনানুগ কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মাধ্যমে ই-ট্রানজেকশন করলে অথবা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিষিদ্ধ লেনদেনে অংশ নিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সর্বোচ্চ এক বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার মুখোমুখি হবেন।

নারী-শিশুদের ব্ল্যাকমেইলিং ও মিথ্যা মামলার কড়া শাস্তির বিধান

ডিজিটাল মাধ্যমে যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং বা অশ্লীল কনটেন্ট ছড়িয়ে নারীদের হেনস্তা কিংবা শিশুদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫-এ। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইলিং, যৌন হয়রানি, রিভেঞ্জ পর্ন, ডিজিটাল শিশু যৌন নিপীড়ন বা সেক্সটর্শনের উদ্দেশ্যে কোনো ভিডিও, অডিও, স্থিরচিত্র বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্বারা নির্মিত কোনো অশ্লীল বা ভীতিকর তথ্য প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন কিংবা এমন হুমকি দেন, তাহলে তা হবে অপরাধ।

এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে, যদি এ অপরাধের শিকার হন কোনো নারী বা ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু, তাহলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

এছাড়া নতুন আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করাও অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে বা ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে যদি মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং এর কোনো আইনানুগ ভিত্তি না থাকে, তাহলে মামলা দায়েরকারীকে সংশ্লিষ্ট ধারায় মূল অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। একাধিক মিথ্যা মামলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দণ্ডের ব্যবস্থাই প্রয়োগ হবে।

এ অধ্যাদেশের আওতায় শুধু ব্যক্তি নয়, কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে সংশ্লিষ্ট মালিক, পরিচালক, ব্যবস্থাপক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীও দায় এড়াতে পারবেন না। অপরাধ রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে তাদেরও অভিযুক্ত করা যাবে। ট্রাইব্যুনাল চাইলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও নির্দেশ দিতে পারবেন।

সাইবার অপরাধের তদন্ত শেষ হবে ৯০ দিনে

বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমন ও বিচার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করতে নতুন অধ্যাদেশে তদন্ত ও বিচারসংক্রান্ত একগুচ্ছ কঠোর বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ অনুযায়ী, সাইবার অপরাধ তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বা নির্ধারিত তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এ সময়সীমা ১৫ দিন এবং পরবর্তীতে আরও ৩০ দিন বাড়ানো যাবে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি-সাপেক্ষে। এছাড়া কোনো মামলার শুরুতে বা তদন্ত চলাকালে প্রয়োজন মনে হলে ট্রাইব্যুনাল যৌথ তদন্ত দল গঠনের নির্দেশ দিতে পারবে, যেখানে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থা একসঙ্গে কাজ করবে।

এছাড়া রয়েছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজিরের বাধ্যবাধকতাও। অধ্যাদেশের ধারা ২১, ২৫ ও ২৬ অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলার নথি ও অভিযুক্তকে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করতে হবে। আদালত তদন্তের নির্দেশ দেবে অথবা ভিত্তিহীন মনে হলে অভিযোগ খারিজ করে মুক্তির নির্দেশ দিতে পারবেন।

পরোয়ানাবিহীন অভিযান ও জব্দের বিধানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে হ্যাকিং বা বেআইনি অনুপ্রবেশের আশঙ্কা থাকলে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার করতে পারবে। তবে, এক্ষেত্রে কারণ লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং আদালতে তল্লাশির প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

তদন্তের স্বার্থে কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক থেকে তথ্য জব্দ করা যাবে। এ তথ্য-উপাত্ত ৯০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণের নির্দেশ দিতে পারবে মহাপরিচালক, যা সর্বোচ্চ ১৮০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে। তবে, তদন্তে সহায়তা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন রাখা বাধ্যতামূলক। কেউ এ তথ্য ফাঁস করলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

তবে, সাইবার অপরাধে মামলার অভিযোগ কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার নিযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে দায়ের করা যাবে। থানা অভিযোগ না নিলে ট্রাইব্যুনালে হলফনামাসহ অভিযোগ দাখিলের সুযোগ থাকছে। পুলিশ বা যৌথ তদন্ত দলের প্রতিবেদন ছাড়া ট্রাইব্যুনাল কোনো মামলার বিচার গ্রহণ করতে পারবে না। তবে, সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে— সাইবার অপরাধের বিচার কেবল ট্রাইব্যুনালেই হবে এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা যাবে।

অনলাইন অপরাধ দমনে স্বচ্ছতার সঙ্গে লাগবে কারিগরি সক্ষমতা : মনজিল মোরশেদ

‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল যোগাযোগের বিস্তৃতির ফলে সাইবার অপরাধও ক্রমে জটিল ও বিপজ্জনক রূপ নিচ্ছে। তাই একটি সুসংগঠিত, আধুনিক ও কার্যকর আইন থাকা আবশ্যক, যা অনলাইন জগতের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে। নতুন অধ্যাদেশ আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষা- দুটোই সমানভাবে নিশ্চিত করতে পারে। এর মাধ্যমে অনলাইনে জালিয়াতি, অপপ্রচার, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ নানা অপরাধ প্রতিরোধে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।’

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

তবে, ওয়ারেন্টবিহীন গ্রেপ্তারের বৈধতার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে যখন ওয়ারেন্টবিহীন গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখন সেটি খুবই সংবেদনশীল একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এমন ক্ষমতা প্রয়োগে যদি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তা ব্যক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘনের আশঙ্কা তৈরি করে। সাইবার অপরাধ রোধ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তার নামে যেন কাউকে হয়রানির শিকার হতে না হয়— এটা নিশ্চিত করাও সমানভাবে জরুরি। আমি মনে করি, এ বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকলে আইনটি আরও গ্রহণযোগ্য হবে।’

আবার এ অধ্যাদেশ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে কারিগরি দক্ষতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন মনজিল মোরশেদ। তিনি বলেন, ‘সাইবার অপরাধের প্রকৃতি জটিল ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। তাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আপডেটেড রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ ও প্রসিকিউশন ব্যবস্থায় বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। একইসঙ্গে জনগণকে সচেতন করাও গুরুত্বপূর্ণ, যেন তারা নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে। এসব পদক্ষেপ এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।’

এ অধ্যাদেশ সময়োপযোগী, তবে বাস্তবায়নে চাই স্বচ্ছতা : ইশরাত হাসান

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’ নিয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিল করে নতুন অধ্যাদেশ প্রণয়নের পেছনে মূলত জনমতের চাপ, সাংবাদিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। আগের আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর যে ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তা শুধু সমালোচনার জন্ম দেয়নি; ব্যবহারিক দিক থেকেও ভোগান্তির কারণ হয়েছিল। বিশেষ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা আইনটির বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে। সেই প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের অধ্যাদেশটি প্রণয়ন একটি সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করছি।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান / ছবি- ঢাকা পোস্ট

তিনি বলেন, ‘নতুন অধ্যাদেশে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। যেমন— অনেক অপরাধ জামিনযোগ্য করা হয়েছে, পুলিশের তাৎক্ষণিক গ্রেপ্তারের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে এবং মানহানি সংক্রান্ত ধারাটি ফৌজদারি অপরাধ থেকে সরিয়ে দেওয়ানি অভিযোগে রূপান্তর করা হয়েছে। এছাড়া সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে যাতে তারা হয়রানির শিকার না হন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো— স্বাধীন রিভিউ বোর্ড গঠনের কথা, যা সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগের নিরপেক্ষ পর্যালোচনা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে।’

‘তবে, অধ্যাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা কতটা বাস্তবে কার্যকর হবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আচরণ, বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ও রেগুলেটরি মেকানিজমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর। এখানে অধিকার রক্ষার কথা বলা হলেও এর বাস্তব প্রয়োগই নির্ধারণ করবে আইনটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করবে নাকি তা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রে পরিণত হবে’— মন্তব্য করেন ইশরাত হাসান।

‘যদি আইনটির অপব্যবহার হয়, কিংবা বিচারবহির্ভূত হয়রানি অব্যাহত থাকে তাহলে সেলফ সেন্সরশিপ বাড়বে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে এবং গণতান্ত্রিক চর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ অধ্যাদেশকে বাস্তবিক অর্থে একটি অগ্রগতি হিসেবে দেখতে হলে তার সঠিক ও দায়িত্বশীল প্রয়োগ নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে জরুরি’।

আরএইচটি/এআইএস