ডাকসুতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ভরাডুবি
গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম নির্বাচনেই কেন এমন হার?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সমর্থিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের (বাগছাস) ভরাডুবি হয়েছে। যে সংগঠনটি ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এ নেতৃত্ব দিয়ে গণমানুষের আস্থা অর্জন করেছিল, তারাই এই নির্বাচনে ২৮টি পদের একটিতেও জিততে পারেনি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং সমন্বয়হীনতার মতো নানা কারণ এই অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পেছনে প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডাকসু নির্বাচনে ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ নামে ২৭ সদস্যের প্যানেল ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস)। এতে ভিপি (সহ-সভাপতি) পদে লড়েন আব্দুল কাদের এবং জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে লড়েন আবু বাকের মজুমদার। নির্বাচনে আব্দুল কাদের পেয়েছেন ১১০৩ ভোট এবং আবু বাকের মজুমদার পেয়েছেন ২১৩১ ভোট। ভোটের হিসাবে দুজনই হয়েছেন পঞ্চম। আর চারটি সম্পাদকীয় পদে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা দ্বিতীয় হয়েছেন। অন্য পদগুলোতে তারা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তৈরি করতে পারেননি। বলা যায় অনেকটা ভরাডুবি হয়েছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনে ভিপি পদে আব্দুল কাদের পেয়েছেন ১১০৩ ভোট এবং জিএস পদে আবু বাকের মজুমদার পেয়েছেন ২১৩১ ভোট। ভোটের হিসাবে দুজনই হয়েছেন পঞ্চম। আর চারটি সম্পাদকীয় পদে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরা দ্বিতীয় হয়েছেন। অন্য পদগুলোতে তারা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তৈরি করতে পারেননি। বলা যায় অনেকটা ভরাডুবি হয়েছে তাদের
কেন এমন ভরাডুবি— প্রশ্ন রাখা হয় এনসিপি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একপাক্ষিক আচরণ এবং প্রচারণায় কৌশলগত নানা ত্রুটির প্রভাবে এমনটি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কিছুটা সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল, ছিল সমন্বয়হীনতাও। যেহেতু নতুন সংগঠন, তারা কিন্তু হলগুলোতে ভালো করেছে। সেন্ট্রাল পোস্টগুলোতে ভালো করেনি কিন্তু অন্যগুলোতে নজরে এসেছে। আমাদের ছাত্র সংগঠনের গ্রোথ যে মাত্রায়, তাদের ফিল্ড অ্যাসেসমেন্টে হয়তো কিছুটা ভুল ছিল। এগুলো নিয়ে তারা এখন কাজ করছে। আশা করি ঠিক করে ফেলবে। তারা সাংগঠনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’
“সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের একটা মূল্যায়ন হয়েছে। আমরা তো ছাত্র সংগঠনকে একটা স্বাধীন জায়গা থেকে চলতে দিতে চাই। তারা তাদের মূল্যায়ন নিয়ে যদি আমাদের সঙ্গে কখনও বৈঠক করতে চায়, সেটা আমরা হয়তো করব। আমাদের অবজারভেশনগুলো তাদেরকে জানাব। ডাকসু’র রেজাল্ট নিয়ে এমনিতে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি, মূল্যায়ন করেছি। তাদের সঙ্গে সেভাবে আনুষ্ঠানিক বৈঠক এখনও হয়নি।”
বিজ্ঞাপন
গত ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ১২ সেপ্টেম্বর রাতে এনসিপি’র নির্বাহী কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিভা, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদসহ নির্বাহী কাউন্সিলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় এজেন্ডা ছিল জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি। তবে ঘুরেফিরে ডাকসু নির্বাচনে পরাজয়ের প্রসঙ্গও আসে। কেন্দ্রীয় সংসদে একজনও জিততে না পারার পেছনে বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেন নেতারা। ডাকসু নির্বাচনে এমন পরাজয়ে হতাশা প্রকাশ করেন তারা।
আরও পড়ুন
বৈঠক সূত্র জানায়, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম নির্বাচনেই এমন ভরাডুবি, নেতাদের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। প্যানেল নিয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাদের মধ্যে বিভাজন দৃশ্যমান হয়ে পড়েছিল। এটা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেননি। এছাড়া অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের (যারা হলে থাকেন না) ভোটে টানতে না পারাও পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে বৈঠকে জানানো হয়। কেউ কেউ মনে করেন, ডাকসুতে এমন ভরাডুবি জাতীয় রাজনীতিতে এনসিপির ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা পোস্টকে বলেন, “শুধু প্যানেল করে দিলেই নির্বাচন হয় না। পুরো নির্বাচনের জন্য পরিকল্পনা, প্যানেল ঠিক করা, যিনি নির্বাচন করবেন তার সক্ষমতা, পরিশ্রম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোভাবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এখানে শিবির সুসংগঠিতভাবে কাজ করেছে।”
তার মতে, ‘শুধু অভ্যুত্থানের বিষয়টি বিবেচনা করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভোট দেননি। তারা দেখেছেন, কাদের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, সেদিকেই তারা ফোকাস করেছেন। অভ্যুত্থান যে সব সময় মনে রাখতে হবে, বিষয়টি সে রকমও নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতি মনোযোগ দেন, নিজেদের ভালো-মন্দ বিবেচনা করেন, এখানে সেটি হয়েছে।’
এমন পরিণতির সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বিশ্লেষণ করেছেন কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো সম্মিলিত কারণে এই পরিণতি। প্রার্থীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব, ডাকসু নিয়ে দল থেকে পরিকল্পনা, প্রার্থীদের সক্ষমতা— সবকিছু মিলিয়েই এমন ভরাডুবি। এখানে একক কোনো কারণ নেই।’
আরও পড়ুন
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদকে অনেকে এনসিপির ছাত্রসংগঠন মনে করেন। ডাকসু নির্বাচনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে আলোচনায় আসা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক আব্দুল কাদের। আর জিএস প্রার্থী ছিলেন সম্মুখসারির আরেক সাবেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। ডাকসু নির্বাচন করবেন বলেই তারা দুজন এনসিপিতে যোগ দেননি— এমন আলোচনা ক্যাম্পাসে রয়েছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত এক বছর ক্যাম্পাসে নানা ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছেন তারা। এই প্যানেলের অন্য প্রার্থীরাও ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতে, প্যানেলভিত্তিক বিভাজনের কারণে সাবেক সমন্বয়কদের প্যানেল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ওপর আস্থা রাখেননি শিক্ষার্থীরা। গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব শিক্ষার্থীদের চোখে পড়েছে এবং এটি তাদের পছন্দ হয়নি বলে জানিয়েছেন তারা। সম্পাদকীয় কয়েকটি পদেও বাগছাসের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। কেউ কেউ নির্বাচনের আগে সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে অন্য প্যানেলে যোগ দেন।
আরও পড়ুন
তবে এনসিপি নেতাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ভূমিকা থাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের অনেক নেতা নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছিলেন। ফলে অনেকে সংগঠনের সিদ্ধান্ত মানতে চাননি, যা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়া কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছিল। কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিতর্ক ও কাদা-ছোড়াছুড়ি— এসবের প্রভাব ভোটের বাক্সে পড়েছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। সেই ভুল শুধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে সবার।
এমএসআই/এমএআর/