রাজধানীর মানিকনগর মডেল স্কুল প্রাঙ্গণে ‘সান্ধ্যকালীন পিঠার’ ব্যবসা করেন স্বামীহারা গুলজাহান বেগম। দিনে বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ এবং সন্ধ্যায় পিঠা বিক্রি করে কোনোমতে তার সংসার চলে। বড় ছেলে হাফিজুল (১১) পাঁচ-ছয় দিন ধরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ছেলে অসুস্থ হওয়ায় তিনি ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না।

গুলজাহান বেগম তার কষ্টের কথা জানিয়ে বলেন, ‘ছেলেকে স্কুলে পড়াতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। মেয়েটাকে এখনও ভর্তি করাতে পারিনি। ছেলেটার ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। কাজেও ঠিকমতো যেতে পারি না। ডাক্তার বলেছে, ডাব-ফলের রস বেশি বেশি খাওয়াতে। দিনে দুটো-তিনটে ডাব কিনতেই ৫০০-৬০০ টাকা চলে যায়। তারপরও বাধ্য হয়ে ডাব কিনতে হয়।’

গুলজাহান বেগমের মতো আরও অনেক মানুষ সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ডেঙ্গুর কারণে বেশি দামে ডাব কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ডাব বিক্রেতারা বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন। হাসপাতাল এলাকার ডাব বিক্রেতারা পাড়া-মহল্লার চেয়ে অন্তত ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন। যদিও তারা ডাব বড় হওয়ার দাবি করছেন, বাস্তবে পাড়া-মহল্লার ডাবের সঙ্গে তাদের ডাবের আকারের কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।

কোথায়, কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে ডাব

রাজধানীর মালিবাগ, রামপুরা, মুগদা ও মানিকনগরের পাড়া-মহল্লায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ডাব সর্বনিম্ন ৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ১৪০ বা ১৫০ টাকা দামের ডাব দর কষাকষির মাধ্যমে ১০-২০ টাকা কমে কেনা যাচ্ছে।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়। হাসপাতালটির সামনে সারা বছরই তিন থেকে চারজন ব্যবসায়ী ডাব বিক্রি করেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর তাদের কাছে ডাবের দাম জানতে চাইলে সর্বনিম্ন ১৪০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম চাওয়া হয়। এসব বিক্রেতা পাড়া-মহল্লার চেয়ে প্রতিটি ডাবে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন

মালিবাগের ডাব-ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, ‘আড়তে পাঁচ সাইজের ডাবের দাম নির্ধারণ করা থাকে। সাইজ বুঝে ডাব কিনে আনতে হয়। আমার কাছে সর্বনিম্ন ৮০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪০ টাকা পর্যন্ত পাঁচ ধরনের ডাব আছে। সবচেয়ে ছোট ডাব আমরা ৫০ টাকায় কিনে আনি, এর সঙ্গে আরও ২০ টাকা খরচ যোগ হয়। ফলে সেটি ৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। আর বড় ডাব ১২০ টাকায় কিনে ১৫০ টাকায় বিক্রি করি।’

মানিকনগরের এক ডাব-ব্যবসায়ী জানান, ডাবের দাম এখন আড়তেই বেশি। তাই আমাদেরও বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ডাবের দাম শুনে অনেকেই না কিনে চলে যান। আমরাও নিরুপায় হয়ে তাদের কাছে বিক্রি করতে পারি না।

হাসপাতালের সামনে ‘ডাব সিন্ডিকেট’

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়। হাসপাতালটির সামনে সারা বছরই তিন থেকে চারজন ব্যবসায়ী ডাব বিক্রি করেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর তাদের কাছে ডাবের দাম জানতে চাইলে সর্বনিম্ন ১৪০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম চাওয়া হয়। এসব বিক্রেতা পাড়া-মহল্লার চেয়ে প্রতিটি ডাবে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশি দাম হাঁকাচ্ছেন।

এক ব্যবসায়ী দাবি করেন, তারা আড়ত থেকে বড় ডাব বাছাই করে কিনে আনেন, যাতে রোগীর জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকে। তাদের বিক্রি করা ডাব পাড়া-মহল্লার ডাবের চেয়ে বড় এবং এতে বেশি পানি থাকে।

তবে, রাজধানীর শাহবাগে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) সামনে ডাব তুলনামূলক কম দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এখানে ছোট ডাব ১২০ টাকা এবং বড় ডাব সর্বোচ্চ ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আড়তে ডাবের দাম কত

কারওরান বাজারের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, এখানে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পাইকারি মূল্যে ডাব বিক্রি হচ্ছে। নোয়াখালী, দিনাজপুর, বরিশাল ও ভোলা থেকে বেশির ভাগ ডাব এখানে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম হাঁকানো হচ্ছে ভোলা থেকে আসা ডাবের।

পাইকারি ব্যবসায়ী মিল্টন বলেন, ‘ভোলার ডাবগুলো তুলনামূলক বড় ও বেশি পানি হয়। এগুলো আমরা ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত পাইকারি দামে বিক্রি করি। আমাদের কাছে নোয়াখালী অঞ্চলের সর্বনিম্ন ৫০ টাকা দামের ডাব আছে। এগুলো খুচরা বিক্রেতারা নিয়ে ৮০-৯০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে।’

পাইকারি বাজারে ডাবের দাম বেড়েছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আগের দামেই বিক্রি করছি। এখন চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। অতিরিক্ত গরম এবং ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার কারণে ডাবের বিক্রি কিছুটা বেড়েছে।’

রোগীরা কেন বাড়তি দামে কিনছেন

একটি বেসরকারি স্কুলে কেরানি পদে চাকরি করেন আমজাদ হোসেন। তার ভাগ্নে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। হাসপাতালের সামনে থেকে গত শনিবার তিনি ৩৫০ টাকায় একজোড়া ডাব কেনেন। অনেকটা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে তিনি ব্যবসায়ীকে বলছিলেন, ‘রোগীরে জবাই করার জন্যই তো এখানে সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করতে বসেছেন। আমার বাসার সামনে দুটো ডাব ২৪০-২৫০ টাকায় কিনতে পারতাম। সেই ডাব এখন ৩৫০ টাকায় কিনতে হলো।’

আমজাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বোন আসার সময় ফোনে বলে দিয়েছে ভাগ্নের জন্য দুটো ডাব কিনে আনতে। এখন বাধ্য হয়েই বেশি দাম দিয়ে কিনতে হলো। এখন তো আর বাসার কাছে গিয়ে কিনে আনা সম্ভব না।’

ডেঙ্গু রোগীর জন্য ডাব কতটা উপকারী

ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ২০২২ সালে তৈরি করা গাইডলাইনে রোগীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর পরিমাণ দৈনিক ৮-১০ গ্লাস। তবে, তরল খাবার মানেই যে শুধু ডাবের পানি খেতে হবে, তা নয়। তরলের ঘাটতি পূরণে দুধ, ফলের রস, পানি, ভাতের মাড়, ওরস্যালাইন বা বার্লিও খাওয়া যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডাবের পানি শরীরের জন্য উপকারী হলেও অতিরিক্ত পান করা ঠিক নয়। কারণ, এতে উল্টো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শুধু ডাব নয়, শরীরে তরলের ঘাটতি পূরণে যেকোনো স্বাভাবিক তরল খাবারই রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করতে পারেন।

‘এছাড়া শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে প্রচুর সোডিয়াম বেরিয়ে যায়। সাধারণত এই পরিমাণ পানি এবং সোডিয়ামের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে। কিন্তু জ্বর হলে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। তাই রোগীকে স্যালাইন দেওয়া হয়, যেখানে ০.৯ শতাংশ সোডিয়াম থাকে। তবে, পটাশিয়াম ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয় না, এটি সাধারণত মলের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।’

ডাবের পানিতে সোডিয়াম কম, কিন্তু পটাশিয়াম বেশি থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পটাশিয়াম গ্রহণ করলে তা কিডনির ওপর চাপ ফেলে। তাই অতিরিক্ত ডাবের পানি খাওয়া উচিত নয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর খাদ্যতালিকায় ডাবের বিকল্প হিসেবে স্যুপ, রঙ চা, সুজি, সেমাই, ফলের রস, বার্লি বা ভাতের মাড়ও দেওয়া যেতে পারে

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম বা ক্লোরাইড শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এসব উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। শরীরে এসব উপাদান বেশি নেওয়াও ভালো নয়, আবার কম হলেও সমস্যা তৈরি হয়। ডাবের পানিতে সোডিয়াম কম, কিন্তু পটাশিয়াম বেশি থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পটাশিয়াম গ্রহণ করলে তা কিডনির ওপর চাপ ফেলে। তাই অতিরিক্ত ডাবের পানি খাওয়া উচিত নয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর খাদ্যতালিকায় ডাবের বিকল্প হিসেবে স্যুপ, রঙ চা, সুজি, সেমাই, ফলের রস, বার্লি বা ভাতের মাড়ও দেওয়া যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কাজী তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডাব ডেঙ্গু চিকিৎসার একমাত্র সমাধান নয়। রোগীকে যেকোনো ধরনের তরল খাবার দেওয়া যেতে পারে। তবে ওরস্যালাইন বেশি খাওয়ানো ভালো।’

তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষ গুজবের কারণে ডেঙ্গু হলে ডাবের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়। প্রকৃতপক্ষে, ডাবের বিকল্প হিসেবে স্যুপ, ফলের রস, বার্লি, ভাতের মাড় এবং যেকোনো ধরনের তরল খাবার খাওয়ানো যেতে পারে।’

এমএমএইচ/এমজে/এমএআর