সাক্ষাৎকার : ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু
বিএনপির ডিএনএতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটা নেই, হাসিনা হিটলার-মুসোলিনির সমতুল্য
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, বিএনপির চরিত্রে ফ্যাসিবাদের কোনো জায়গা নেই। বিএনপি সম্পূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক দল। যদি দলের চরিত্রে ফ্যাসিস্ট মনোভাব থাকত, তাহলে বেগম খালেদা জিয়া ফ্যাসিস্ট হতে পারতেন। কারণ, তিনি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তিনি পরপর দুটি নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিরোধী দলে চলে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবার নির্বাচন হয়েছে, সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। সুতরাং বিএনপির ডিএনএ-তে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটাই নেই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিএনপি কোনোদিনই ফ্যাসিস্ট দল হবে না। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সেটি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, এমন প্রবণতাও নেই।’
সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইকবাল হাসান মাহমুদ এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের চিফ অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্টেট অ্যাফেয়ার্স আদিত্য রিমন।
বিজ্ঞাপন
সাক্ষাৎকারে তিনি চলমান রাজনীতি, জাতীয় নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র, জামায়াতের পিআর কার্যক্রম, দলটির সঙ্গে বিএনপির জোট, জোটের কারণ ও কৌশল নিয়ে কথা বলেন। নিজের বিরুদ্ধে জোট সরকারের আমলে ওঠা অভিযোগের বিষয়েও কথা বলেন বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা এই রাজনীতিবিদ। মতামত দেন আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির তৎপরতা সম্পর্কেও। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও কথা বলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
ঢাকা পোস্ট : অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার কথা। এই নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির প্রস্তুতি কেমন? বিশেষ করে প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার প্রণয়ন ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাই।
বিজ্ঞাপন
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি সবসময় থাকে। গত ১৬-১৭ বছর আমরা ক্ষমতার বাইরে ছিলাম, নির্বাচন করতে পারিনি, কিন্তু বসে থাকিনি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কী হবে, দেশে কী ধরনের সমস্যা আছে— বিষয়গুলো ধরে ধরে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন। তারই প্রতিফলন হচ্ছে রাষ্ট্র বিনির্মাণ ও সংস্কারের ৩১ দফা। সুতরাং আমাদের হাতে সেই ৩১ দফা রয়েছে, আর আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহারও এরই আলোকে তৈরি হবে।
গত ১৭ বছরে আমাদের কোনো নেতাকর্মী দলত্যাগ করেননি, সবাই আন্দোলনের মাঠে ছিলেন। এখন সেই পোড়খাওয়া নেতাকর্মীদের অনেকেই মনে করেন, সংসদ নির্বাচনে তারা সবাই যোগ্য।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কী হবে, দেশে কী ধরনের সমস্যা আছে— বিষয়গুলো ধরে ধরে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন। তারই প্রতিফলন হচ্ছে রাষ্ট্র বিনির্মাণ ও সংস্কারের ৩১ দফা। সুতরাং আমাদের হাতে সেই ৩১ দফা রয়েছে, আর আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহারও এরই আলোকে তৈরি হবে
ঢাকা পোস্ট : আগস্ট-পরবর্তী রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। যেটা বিগত ১/১১ সরকারের সময় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় শক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত নির্বাচনে ‘আওয়ামী লীগ নাই’ বলা যায়। যদিও এর মধ্যে জামায়াত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে, যার সমাধানও হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে আগামী নির্বাচনের কিছুটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে কি না?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : ওয়ান-ইলেভেনের পর দুটি বড় দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল। মানুষ এই দুই দলকে পছন্দ করেছিল। তাদের পছন্দ অনুযায়ী যখন যাকে প্রয়োজন মনে করেছে, তাকে ভোট দিয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
বেগম খালেদা জিয়া ৯৬ সালের আগে জনগণের ভাষা বুঝতে পেরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার খুব সুন্দরভাবে কাজ করেছিল এবং জনগণও রায় দিতে পেরেছিল। যদিও নির্বাচন নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠে ছিল। তারপরও গাছটা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) বড় হচ্ছিল, অথচ শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য, তারা জানে যে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন দিলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে, তাই বিএনপিকে ঠেকানোর জন্য তিনি (শেখ হাসিনা) গাছটাকে মেরে ফেললেন! ফলে দেশের মধ্যে একটা চরম অরাজকতা সৃষ্টি হলো। মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু হলো। আমি ইতিহাস পড়ি। হিটলার ও মুসোলিনি যা করেছিলেন, তার সঙ্গে শেখ হাসিনার শাসনযন্ত্রের তুলনা করলে পার্থক্য খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আমরা ঘর থেকে বের হতে পারতাম না। আমার স্ত্রীও গুলি খেয়েছিল কিন্তু কেন? বিএনপি করে এজন্য। এমন একটা পরিস্থিতি করে দেশের মধ্যে একটা ভ্যাকিউম (শূন্যস্থান) তৈরি করা হয়েছিল।
ইতিহাসে দেখা যায়, যখনই এই ধরনের একটা দানব, ফ্যাসিস্ট ১৬-১৭ বছর ক্ষমতায় থাকে তখন ওই ছায়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় উত্থান হয় উগ্রপন্থার।
যদি আমরা মিশর দেখি, সেখানে সবাই আরব স্প্রিং (আরব বসন্ত) বলে চিল্লাচিল্লি করল। কিন্তু যখন উগ্রপন্থার উত্থান হলো তখন আবার সেই মিশরের অবস্থা একই স্থানে ফিরে এলো। আমাদের দেশেও কিন্তু তাদের উত্থান হয়েছে। হাসিনা চলে গেছে কিন্তু জিনিসটা এভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বিএনপি যেন উগ্রপন্থার চাপে পড়ে। এই জিনিসটা হাসিনা পরিকল্পিতভাবে করে গেছেন। দেশটা অকার্যকর করা হয়েছে। ফলে আজ বিভিন্ন শক্তির উত্থান হয়েছে। আজ ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতা দেখানো হচ্ছে, যেটা কোনোদিনও কাম্য ছিল না। আমাদের মতো বয়সী যারা আছেন, ছাত্র অবস্থায় আন্দোলন করে আইয়ুব খানকে হটিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের জন্য এটা কাম্য নয়। আল-বদর, আল-শামস অর্থাৎ যারা আমাদের দেশের লোকজনকে হত্যা করছিল, তারা যদি মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে আজ বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। এই অবস্থা হাসিনা সৃষ্টি করে গেছেন। প্রশাসন, জুডিশিয়াল সার্ভিস ধ্বংস করে গেছেন। কোনটা তিনি রেখে গেছেন?
হিটলার ও মুসোলিনি যা করেছিলেন, তার সঙ্গে শেখ হাসিনার শাসনযন্ত্রের তুলনা করলে পার্থক্য খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আমরা ঘর থেকে বের হতে পারতাম না। আমার স্ত্রীও গুলি খেয়েছিল কিন্তু কেন? বিএনপি করে এজন্য। এমন একটা পরিস্থিতি করে দেশের মধ্যে একটা ভ্যাকিউম (শূন্যস্থান) তৈরি করা হয়েছিল
এখন প্রশাসনে মধ্যে হাসিনার যেসব লোকজন বসে আছেন, তারা ড. ইউনূসের সরকারকে সহায়তা করছেন না। তারা সহযোগিতা করলে এত কিছু, এত ঘটনা ঘটত না। এখন উল্টো ঘটনা ঘটছে। ড. ইউনূস নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। আমি মনে করি, ভেরি পজিটিভ স্টেপ (খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ) উনি নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যারা জানে যে নির্বাচনে গেলে জিতবে না, তাদের ভোটের সংখ্যা কম। তারা ক্ষমতায় আসবে না। এখন নির্বাচন ঠেকাতে হবে। আর নির্বাচন ঠেকানোর জন্যই এই পিআর ঘোষণা নিয়ে এসেছে। এটা আর কিছুই না।
দেশকে আরও অস্থিতিশীল জায়গায় ঠেলে দিয়ে উদার পন্থার দলগুলোকে যাতে কোণঠাসা করা যায় এবং তারা যেন ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করছে। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ পড়ে গেলেও তাদের টাকাও কমেনি, শক্তিও কমেনি। সুতরাং তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে যেয়ে আজ আওয়ামী লীগের উত্থান ফের ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছে।
একজন সাংবাদিক, নাম বলতে চাই না, বলেছেন— ‘রাজাকারের রাজাকার নির্বাচন হবে।’ যে সাংবাদিক এটি বলেছেন, তার বয়স ’৭১ সালে কত ছিল? আমরা তো এখনও বেঁচে আছি। আমরা নির্বাচন করব, আমি কি রাজাকার? বিএনপি কি রাজাকারের দল? বিএনপি সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধার দল। বিএনপির সৃষ্টি হয়েছে মাঠে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধার (জিয়াউর রহমান) হাত ধরে।
আমি অবাক হয়েছি, কিছু সাংবাদিক এখন এই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ‘হাসিনার দুর্নীতি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন, আগেও তো দুর্নীতি হয়েছে।’ হাসিনার দুর্নীতির সঙ্গে আগের দুর্নীতির বিশাল পার্থক্য আছে। তিনি আইন পরিবর্তন করে দুর্নীতি করেছেন, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, ঋণ তুলে লুট করেছেন।
আগের দুর্নীতির সঙ্গে হাসিনার দুর্নীতির তুলনা করে কি তার অপরাধকে সমর্থন করা হয় না? তাদের মতো শিক্ষিত মানুষগুলো কীভাবে এটাকে সমর্থন দিতে পারেন? সত্যি আমি অবাক ও হতাশ হয়েছি। মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের চোখ ও মনকে খোলার জন্য। আমরা না হয় রাজনীতি করি, কিন্তু তারা তো রাজনীতিবিদ নন, তাদের চোখ ও মন তো খোলা থাকা উচিত। এই ধরনের বক্তব্য রাজনীতিকে আরও ঘোলাটে করবে। উদ্দেশ্য একটাই— নির্বাচন যেন সুষ্ঠুভাবে না হয়, সেই ব্যবস্থা করা। এখন দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা যেমন নেমে পড়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাও একইভাবে মাঠে নেমেছে। দুই পক্ষই একই উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
ঢাকা পোস্ট : আপনার বক্তব্য ধরে বলতে চাই, ২০০৪ সালের আগে থেকে বিএনপি ও জামায়াত জোটসঙ্গী ছিল। বিগত ১৫ বছর জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর সেই জামায়াত বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে…
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : আমরা ইনক্লুসিভ (সকলকে অন্তর্ভুক্ত করা) রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধানে যে সংশোধনগুলো আনেন, তার মাধ্যমে তিনি ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণা প্রবর্তন করেন। বলেন, ‘এই দেশে যারা আছে, সবাই বাংলাদেশী। সবার অধিকার সমান।’ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো দেশে নিষিদ্ধ ছিল। ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল, প্রশ্ন উঠেছিল, কেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মভিত্তিক দল রাজনীতি করতে পারবে না, যখন বিশ্বের বহু দেশে এমন দল রাজনীতি করছে।
আজ ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করার ধৃষ্টতা দেখানো হচ্ছে, যেটা কোনোদিনও কাম্য ছিল না। আমাদের মতো বয়সী যারা আছেন, ছাত্র অবস্থায় আন্দোলন করে আইয়ুব খানকে হটিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের জন্য এটা কাম্য নয়। আল-বদর, আল-শামস অর্থাৎ যারা আমাদের দেশের লোকজনকে হত্যা করছিল, তারা যদি মুক্তিযুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করে তাহলে আজ বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকে না। এই অবস্থা হাসিনা সৃষ্টি করে গেছেন
এই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শনের অংশ হিসেবেই জিয়াউর রহমান সকলকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভোটের পরিমাণ খুবই সীমিত, প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ। নির্বাচনের রাজনীতিতে সমঝোতা একটি প্রচলিত প্রক্রিয়া; এটি ভারত, পাকিস্তানসহ নানা দেশেই হয়ে আসছে। সেই নির্বাচনী বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলাম, তাদের দুজনকে মন্ত্রীও করা হয়েছিল। তবে, আমরা কখনোই জামায়াতের আদর্শে দীক্ষিত হইনি, কিংবা তাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে ধারণ করিনি, কখনো করব না। কারণ, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সুতরাং, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি অস্থায়ী নির্বাচনী সমঝোতা, আদর্শগত নয়।
আপনারা দেখেছেন যে, ২০১৪ সালের পর থেকে বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে ওঠা-বসা কিংবা আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি। আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছি। অন্য ইসলামী দল, বামদের সঙ্গে করছি কিন্তু তাদের সঙ্গে করিনি।
জামায়াতের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, তারা সবসময় একটি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন হোক, পাকিস্তানের স্বাধীনতা কিংবা ব্রিটিশ বিভাজনের সময়— সব ক্ষেত্রেই তারা একটি নেগেটিভ রোল প্লে (নেতিবাচক ভূমিকা পালন) করেছে। এমনকি পাকিস্তানে যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছিল, তখনও তারা লাহোরে দাঙ্গা সৃষ্টি করে আইয়ুব খানকে মার্শাল ল জারির সুযোগ করে দিয়েছিল। সুতরাং, দলটির চরিত্রই এমন, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।
এখন আবার তারা ‘পিআর সিস্টেম’ ইস্যু তুলে নানা বিভ্রান্তি তৈরি করছে। আমি প্রশ্ন করতে চাই— এই পিআর সিস্টেম আসলে কী? বাংলাদেশের মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই প্রার্থী দেখে ভোট দেয়। মানুষ চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা সংসদ সদস্য— সবার ক্ষেত্রেই প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, কাজ ও জনপ্রিয়তা বিচার করে ভোট দেয়।
বাংলাদেশ একটা সমস্যা-সংকুল দেশ। এখানে পারিবারিক বিরোধ থেকে শুরু করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, চাকরি— নানা দাবি নিয়ে সংসদ সদস্যদের কাছেই আসে মানুষ। জনগণের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। এখন যে উদ্ভট যুক্তি দিয়ে পিআর সিস্টেম-এর কথা বলা হচ্ছে, এর মানে দাঁড়ায়, আমার ভোট নেই। তারা ভুলে যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ শুধু মার্কা দেখে ভোট দেয় না। তারা প্রার্থীর যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব ও কাজকে গুরুত্ব দেয়। আমার কাছে এটি সম্পূর্ণ কু-যুক্তি মনে হয়। আশা করি, তাদের সুবুদ্ধির উদয় হবে।
আবার তারা বলছে, পিআর সিস্টেম না হলে নির্বাচনে যাবে না। অথচ বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও জামায়াতের প্রার্থীরা দাঁড়িপাল্লা মার্কা নিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রচারণা চালাচ্ছে। তাহলে তারা আসলে কী চায়, নির্বাচন নাকি বিরোধিতা? এটা বোঝা কঠিন। এটাই তাদের চরিত্র।
আমরা মুসলমান, আমাদের সামনে আল্লাহর কোরআন ও রাসূলের বাণী আছে। এখন ভালো মুসলমান হওয়ার জন্য আমাকে জামায়াত হওয়া লাগবে নাকি? এখন তারা আমাদের মুসলমান বানাবে? বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল আছেন। তার জন্য জামায়াতের দূতিয়ালি লাগবে না। সুতরাং আমি মনে করি, যারা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে চায়, তারা মূলত ধর্মকে খাট করে। এটা আগেও বলছি, আজও বলছি।
নির্বাচনী বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলাম, তাদের দুজনকে মন্ত্রীও করা হয়েছিল। তবে, আমরা কখনোই জামায়াতের আদর্শে দীক্ষিত হইনি, কিংবা তাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে ধারণ করিনি, কখনো করব না। কারণ, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সুতরাং, জামায়াতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি অস্থায়ী নির্বাচনী সমঝোতা, আদর্শগত নয়
ঢাকা পোস্ট : ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি। সরকার গঠন করতে পারলে আপনাদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, থাকলে প্রাথমিকভাবে কোন কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : এখন পর্যন্ত আমরা নির্বাচনী মেনিফেস্টো (নির্বাচনী ইশতেহার) তৈরি করিনি। জিনিসগুলো ইশতেহারে থাকে এবং সেটি নিয়ে কাজ চলছে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে এটির কাজ চলছে, উনি বিভিন্ন সেক্টরের এক্সপার্টদের সঙ্গে বসে কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। যখনই তফসিল ঘোষণা করা হবে, আমরা নির্বাচনের প্রার্থী ঘোষণা করব, তখন আমাদের ইশতেহারের মধ্যে ১০০ দিন, ১৫০ দিন, ২০০ দিন— সব পরিকল্পনাই থাকবে।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : রাজনীতিবিদদের ওপর ১/১১ সরকারের সময় যে ধরনের অত্যাচার হয়েছে, সেটা আইয়ুব খানও করেনি। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তৃতীয় পক্ষের প্রবেশ করার যে সিস্টেম, বর্তমানে তার অবসান হয়েছে কি না?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : অবসান এখনও হয়নি। যতদিন দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি থাকবে, ততদিন এই অবস্থার অবসান হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে— এই ঘটনাগুলো কে ঘটাচ্ছে, কারা এর পেছনে আছে, এই ছায়াশক্তি আসলে কে? আরেকজন বসে আছে দিল্লিতে, তার লোকজন হালুয়া-রুটি খাচ্ছে, টাকার তো অভাব নেই। এই পরিস্থিতিতে যখন ঐক্যের প্রয়োজন, তখনই কিছু মানুষ ঐক্য বিনষ্ট করছে। বিএনপি জনগণের বেশি ভোট পায়, সেজন্য নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে বিএনপিকে ঠেকানোর জন্য। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব— সাধু, সাবধান! আওয়ামী লীগ বসে আছে, সুযোগটা তারা নেবে। এই যে আবার ’৭১-এর মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, সেই পুরনো স্লোগান তোলা হচ্ছে, আবার সেই স্লোগান নিয়ে আসবে আর মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করবে।
আমরা মুসলমান, আমাদের সামনে আল্লাহর কোরআন ও রাসূলের বাণী আছে। এখন ভালো মুসলমান হওয়ার জন্য আমাকে জামায়াত হওয়া লাগবে নাকি? এখন তারা আমাদের মুসলমান বানাবে? বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল আছেন। তার জন্য জামায়াতের দূতিয়ালি লাগবে না। সুতরাং আমি মনে করি, যারা ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করতে চায়, তারা মূলত ধর্মকে খাট করে। এটা আগেও বলছি, আজও বলছি
ঢাকা পোস্ট : আপনি নিজেও বলেছেন যে, অনেকে তুলনা করার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের আমলে যে দুর্নীতি হয়েছে, বিএনপির আমলেও তা হয়েছে। এমনও প্রচার আছে যে, বিএনপির আমলে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সামনে ক্ষমতা গেলে বিএনপিও একই কাজ করবে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : বিএনপিকে প্রথমবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বলা হয়েছিল, সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে আমাদের সময় লেগেছে, আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটার সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। সবাই জানে আওয়ামী লীগ কীভাবে লুটপাট করেছে, কত টাকা নিয়ে বিদেশে গেছে। এখন সবই ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। তারা যে পরিমাণ টাকা নিয়ে গেছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। আজ উপদেষ্টারাও বুঝতে পারছেন, দেশ কীভাবে চলছে। ব্যাংকগুলো খালি করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি যখন ক্ষমতা ছাড়ে, তখন দেশের রিজার্ভ অনেক বেশি ছিল, আর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৫ শতাংশ। সুতরাং, বিএনপির বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো দেওয়া হয়, সেগুলো অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয় না। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলের দুর্নীতি সরাসরি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।
আজ আমরা দেখি, প্রতিটি নাগরিকের ওপর ঋণের বোঝা কতখানি বেড়ে গেছে। বিএনপির সময়ে এ ঋণের পরিমাণ কত ছিল, আর এখন কত— সেটা হিসাব করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, হাসিনার সরকারের সময় কী পরিমাণ চুরি হয়েছে। বিএনপির আমলে তো লন্ডনে কোনো মন্ত্রীর ১৭০টি বাড়ি থাকার খবর পাওয়া যায়নি। সুতরাং, বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা ধোপে টেকে না। একজন জ্ঞানী মানুষ, আমি তার নাম বলতে চাই না, যিনি আমার ভাগনের সহপাঠী, যার বয়স ’৭১ সালে ছিল মাত্র দুই-আড়াই বছর, তিনি আজ এসব কথা বলছেন। এটা শুনে কষ্ট হয়।
ঢাকা পোস্ট : আপনার বইতে নিজের এবং পরিবারের কারাবরণের জন্য গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত মিথ্যা নিউজকে দায়ী করেছেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমাদের গণমাধ্যমের যে চরিত্র ছিল সেখানে এখন কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না? আগামীতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য বিএনপির বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : বিএনপির আমলে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ছিল বলেই তখন কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে খবর হতো। বিএনপির আমলে সাংবাদিকরা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন, গত ১৬ বছরে হাসিনার সময়ে তা কেউ করতে পেরেছেন কি? বিএনপি কিন্তু তোষামোদকারী সাংবাদিক তৈরি করেনি। হাসিনা করেছেন, তিনি তোষামোদকারী সাংবাদিক তৈরি করেছেন এবং তারা এখন খুবই শক্তিশালী। বড় বড় জায়গায় অবস্থান করছেন। এক-একজনের নাম শুনলেই ভয় লাগে। আমরা সবসময় উন্মুক্ত থাকতে চাই, সাংবাদিকবান্ধব হতে চাই।
যতদিন দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তি থাকবে, ততদিন এই অবস্থার অবসান হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলো কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে— এই ঘটনাগুলো কে ঘটাচ্ছে, কারা এর পেছনে আছে, এই ছায়াশক্তি আসলে কে? আরেকজন বসে আছে দিল্লিতে, তার লোকজন হালুয়া-রুটি খাচ্ছে, টাকার তো অভাব নেই। এই পরিস্থিতিতে যখন ঐক্যের প্রয়োজন, তখনই কিছু মানুষ ঐক্য বিনষ্ট করছে
আমার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আনা হয়েছিল ‘খাম্বা’ নিয়ে। কিন্তু খাম্বা (থাম, স্তম্ভ বা খুঁটি) তো এককভাবে কেনা হয়নি, এটা ছিল একটা প্রকল্পের অংশ, যার নাম ছিল ‘গ্রামীণ বিদ্যুৎ’। সেই প্রকল্পের জন্যই ইএসআই অর্থ দেয়, আর সেই টাকা দিয়েই কাজটি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ১৬ বছর কেটে গেছে, তার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর, কিন্তু খাম্বা নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো দুর্নীতি বের করতে পারেনি। অথচ আমার বিরুদ্ধে ইয়েলো সাংবাদিকতা করা হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় যে তদন্ত করেছিল, সেই তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মতিন পাটোয়ারী। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘যতদিন সাংবাদিকতা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত বিদ্যুতের উন্নতি হবে না’। তাই কোনো তকমা একবার লাগলে সেটা উঠানো খুবই কঠিন হয়। এর দায় কার, সেই প্রশ্নটাই বড়।
ঢাকা পোস্ট : আগামী নির্বাচনে বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের জন্য কতটি আসন ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : এ বিষয়ে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আছে। আসন কতটা ছাড় দেওয়া হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। আগে নির্বাচনের ঘোষণা আসুক, তারপর আলোচনা করে কোথায়, কাকে এবং কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা নির্ধারণ করা হবে। এই মুহূর্তে আমি সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
ঢাকা পোস্ট : রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা হচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা হতে পারে। একইসঙ্গে জামায়াতকে নেওয়ার জন্যও বিভিন্ন পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে বিএনপির ওপর...
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নই। কারণ, এসব বিষয় আমি নিজে হ্যান্ডল করি না। হ্যাঁ, সমাজে অনেক ধরনের কথা প্রচলিত আছে। সুতরাং, এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।
ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠবে কি না, আপনি কি মনে করেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : বিএনপির চরিত্রে কখনোই স্বৈরাচারের প্রবণতা ছিল না। বিএনপি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক একটি দল। যদি দলের চরিত্রে ফ্যাসিবাদ থাকত, তবে বেগম খালেদা জিয়া ফ্যাসিস্ট হতে পারতেন। কারণ, তিনি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরপর দুটি নির্বাচন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে বিরোধী দলে গেছেন। আবার নির্বাচন হয়েছে, তিনি জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। পরবর্তীতে নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। তাই, বিএনপির ডিএনএ-তে ফ্যাসিস্ট মানসিকতা নেই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিএনপি কোনোদিনই ফ্যাসিস্ট হবে না। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটি হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। সেই প্রবণতাও নেই।
বিএনপিকে প্রথমবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বলা হয়েছিল, সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে আমাদের সময় লেগেছে, আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সময়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেটার সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না
ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ আপনি কীভাবে দেখেন?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : আওয়ামী লীগ শুধু দেশের কাঠামো ধ্বংস করেনি, আমাদের জাতির সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়— মুক্তিযুদ্ধ, সেটিও ধ্বংস করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে তারা বিক্রি করে পণ্যে পরিণত করেছে। এটির যে ঐতিহাসিক মর্যাদা ছিল, সেটি নষ্ট করে ফেলেছে।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম বা সঙ্গে ছিলাম, তারা জানি যে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ফল এবং তিনিই দলটির প্রতিষ্ঠাতা। তাই আমরা মুক্তিযুদ্ধকে কোনোদিনও পণ্য বানাব না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় গৌরবের ইতিহাস। এটি আমরা সংরক্ষণ ও সম্মানিত করার চেষ্টা করব। যতদিন বিএনপি আছে, মুক্তিযুদ্ধকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
ঢাকা পোস্ট : দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরতে পারেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে তিনি কোনো বাধার সম্মুখীন হতে পারেন কি না?
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু : যখনই উপযুক্ত সময় আসবে, তিনি অবশ্যই ফিরবেন। আমি মনে করি, তার নির্বাচনে অংশগ্রহণে কোনো বাধা থাকবে না। যেসব (আইনি) বিষয় এখনও আছে, সেগুলো আশা করি নির্বাচনের আগেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
একনজরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির রাজনীতিবিদ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। এছাড়া, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্য তিনি।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের কয়েলগাঁতী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৩৭ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪২ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি এবং ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদমন্ত্রী হন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সরকারে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় ২০০৭ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর গামছা দিয়ে দুই চোখ বেঁধে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই দিন বিডিআর ক্যাম্পে রেখে পরে তাকে মোহাম্মদপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন তার সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা প্রথম যোগাযোগ করতে পারেন। পরে তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে তারা খালাস পান।
এএইচআর/