কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বেশি দামে ট্যাব কেনা’র ঘটনা নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এবার বের হয়ে এলো বেশি দামে ট্যাব কেনার পেছনের আরেকটি রহস্য।

জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করা এবং প্রশিক্ষণের নামে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার ছক করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিবিএস কর্মকর্তারা। অনেকটা এ কারণেই বেশি দরদাতাকে ট্যাব কেনার কাজ দেওয়ার তোড়জোড় চলছে।

ট্যাব কেনার দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে উল্লেখ আছে এই বিদেশ ভ্রমণ আর প্রশিক্ষণের বিষয়টি। যদিও কোনো দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে এসব শর্ত থাকার কথা নয় এবং এটিকে ‘নজিরবিহীন’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশ ভ্রমণসহ প্রশিক্ষণের নামে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি যে দরপত্রের স্পেসিফিকেশন-এ আছে সে সংক্রান্ত কাগজপত্র ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।

দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে বলা হয়েছে, স্থানীয় ও বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে টেকনোলজি স্থানান্তর করা হবে। যেসব দেশে বড় পরিসরে জনশুমারির মতো কাজগুলো ডিজিটালি করা হয়, সেসব দেশে পাঁচদিনের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণে যাওয়া হবে। এই প্রশিক্ষণে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিবিএস ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মোট ২০ কর্মকর্তা অংগ্রহণ করবে। ১০ জন করে দুটি টিমে বৈদেশিক ভ্রমণে অংশ নিবেন কর্মকর্তারা। আর এ সকল কর্মকর্তাদের যাবতীয় খরচ বহন করবে বিবিএসকে ট্যাব সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানটি।

দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠান কাজ পাবে সেই প্রতিষ্ঠানকে ৩০ জন কর্মকর্তাকে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এই প্রশিক্ষণে প্রতিদিন জনপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকা সম্মানি দিতে হবে। স্থানীয় প্রশিক্ষণেরও যাবতীয় খরচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।

জনশুমারি ও গৃহগণনার উপ-প্রকল্প পরিচালক লিজেন শাহ নঈম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের শুমারিটা ডিজিটালি করা হচ্ছে। এর আগে আমাদের ডিজিটাল শুমারি করার অভিজ্ঞতা নেই। যেহেতু মূল শুমারিটা ট্যাবের মাধ্যমে করা হবে, সেহেতু অনেক ট্যাব ক্রয় করতে হবে। যদি বিদেশি কোনো কোম্পানি এই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করত তাহলে তাদের কারখানা পরিদর্শনের বিষয় থাকে। এজন্যই স্পেসিফিকেশনে বিদেশের বিষয়টি রাখা হয়েছে।’

কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য স্পেসিফিকেশন তৈরি করেছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কখনোই সমর্থন করি না। এগুলো গ্রহণযোগ্য কথা নয়। আপনারা সাংবাদিক, আমাদের সহযোগিতা করেন। আমরা উন্মুক্ত টেন্ডার করেছি। সেখানে নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার প্রশ্ন আসবে কেন।’

এ বিষয়ে জানতে ট্যাব কেনার প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহাম্মদকে একাধিকবার ফোন করার পর তিনি রিসিভ করে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে ভাই, আমি ব্যস্ত আছি’। এ কথা বলেই ফোন কেটে দেন তিনি। 

উল্লেখ্য, ট্যাব কেনার টেন্ডার শিডিউল ক্রয় করেছিল আটটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিবিএস-এর শর্তের কারণে ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। টেন্ডারে অংশ নেওয়া ২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশি দরদাতাকে কাজ দেওয়ার তোড়জোড় চলছে বলে জানা গেছে। যদিও সাধারণত কম (সর্বনিম্ন) দরদাতাকেই টেন্ডারে কাজ দেওয়ার নিয়ম আছে।

২০ জনের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে বিবিএস মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টা আমি আগে জানতাম না, পরে জেনেছি। এটা স্পেসিফিকেশনে দেওয়া আছে, কিন্তু বিষয়টি শুরুতে আমাদের নজরে আসেনি।’

তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টা স্পেসিফিকেশনে কেন এলো এটা পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ জানতে চেয়েছে। আমি নিজেও স্পেসিফিকেশন কমিটির সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে, যদি আমাদের দেশীয় কোন প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ না নেয়, যদি বিদেশি কোম্পানি অংশ নিয়ে কাজ পায় তাহলে তাদের ফ্যাক্টরিসহ কোম্পানিটির অনেক বিষয় পরিদর্শন করতে হবে। এজন্যই বিদেশে ভ্রমণের বিষয়টা রাখা হয়েছে। তবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারত।’

স্থানীয় প্রশিক্ষণের বিষয়ে ডিজি বলেন, ‘টোটাল ট্রেনিংয়ের বিষয়টাই আমাদের নলেজে ছিল না। এখন আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি। স্পেসিফিকেশনে বিদেশ বা প্রশিক্ষণের বিষয়টি কীভাবে এলো সেটি খুঁজে বের করবে কমিটি।’

বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘না তো! টেন্ডার স্পেসিফিকেশনে এরকম কোনো বিষয় নেই। স্পেসিফিকেশন আপনার কাছে থাকলে তো হবে না। টেন্ডারে এরকম কোনো বিষয় থাকার কথা নেই।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় প্রশিক্ষণ আছে কি না আমি জানি না, তবে সার্ভিস আছে। যারা কাজ পাবে তারা প্রশিক্ষণ দিবে না। প্রশিক্ষণ আলাদা বিষয়। প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়ার কথা নয়। সুনির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে আমি জানি না। তবে এই শুমারিতে কোনো প্রশিক্ষণ থাকার কথা নয়। স্পেসিফিকেশনের এত গভীর বিষয় আমার জানা নেই। তবে আপনি যেটা বললেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়টি মোটেই নেই। এটা আপনার ভুল ধারণা অথবা ভুল তথ্য। আপনার কাছে কাগজ থাকলেও হবে না, এই ধরনের কোনোকিছু থাকবে না। এটা কোনোভাবেই থাকার বিষয় নয়।’    

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তথা বিবিএস এর সবচেয়ে বড় ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ শীর্ষক প্রকল্পটি শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকবার হোঁচট খেয়েছে। যার ফলে প্রকল্পটির সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা’ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেন একনেক চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে। প্রকল্পের অধীনে কাজ পাওয়া কোম্পানি বিদেশ ট্যুর বাবদ টাকা দিতে বাধ্য থাকবে- সেটা কিন্তু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। টাকার পরিমাণ যাই হোক না কেন এটা অনিয়ম বা দুর্নীতি। কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই এ ধরনের ব্যয় বহন করতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘এখনকার পরিস্থিতিতে এই প্রশিক্ষণের প্রস্তাবটাই আমার কাছে অবাস্তব মনে হচ্ছে। করোনার ফলে এখন অনলাইনেই সবকিছু করা যায়। বর্তমান বিশ্বে সব সেমিনার, প্রশিক্ষণ অনলাইনের মাধ্যমে করা হচ্ছে। আমার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। প্রশিক্ষণটা তাদের সম্পদ বিকাশের উপায় হিসেবে দেখা কোন অবস্থায়ই গ্রহণযোগ্য নয়।’

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনাকালে বেশিরভাগ প্রকল্প থেকেই বিদেশ সফর বাদ দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প থেকে অপ্রয়োজনীয় খাতের অর্থ বরাদ্দ বাদ দিয়ে দেশের অর্থ সাশ্রয় করা হচ্ছে। বিবিএস ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থে বিদেশ ভ্রমণ করবে- বিষয়টি জানা নেই। ফাইলটা আমার কাছে আসলে বিষয়টি দেখব।’

এসআর/জেএস