• অধিক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগে অবকাঠামো উন্নয়ন
• প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ২৫৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা
• প্রকল্প শুরুর পর থেকে সাতবার পরিচালক পরিবর্তন
• সাড়ে ৩ বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ০.০৮২ শতাংশ
• ভারতের ব্যাপক শর্তে বাস্তবায়নে দেরি : ড. জাহিদ

উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে অংশ নিতে প্রযুক্তিভিত্তিক কারিগরি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই ‘অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সৃষ্টিতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। 

প্রকল্প অনুমোদনের পর প্রায় ৪০ মাস পার হয়ে গেলেও এখনও কোনো কাজ করা হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভারত সরকারের ২ হাজার ১৮৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে প্রকল্পটির আওতায় ভারতীয় ঋণের অংশের কোনো অর্থ খরচ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যার ফলে প্রকল্পে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখতে না পেয়ে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ভারত সরে দাঁড়াতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয় এ প্রকল্প | ছবি- সংগৃহীত 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এ প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি ভারত সরকারের ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, প্রকল্পটিতে ভারতীয় ঋণ নিয়েই টানাটানি শুরু হয়েছে। আমরা ইআরডি থেকে ভারতকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে ক্ষুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের এ প্রকল্পে ঋণ দেওয়া থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

কম্পিউটার, তড়িৎ (ইলেকট্রিক্যাল), যন্ত্রকৌশল (মেকানিক্যাল), পুরকৌশল (সিভিল) থেকে শুরু করে খাদ্য, পর্যটন, চিকিৎসাপ্রযুক্তির মতো প্রায়োগিক বিষয়গুলো পড়ানো হয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে। মূলত কর্মমুখী শিক্ষায় আগ্রহ রয়েছে এমন শিক্ষার্থীরাই এখানে ভর্তি হন। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৫৫৫টি ইনস্টিটিউটে আসন সংখ্যা পৌনে ২ লাখের কাছাকাছি। 

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) অজিত কুমার ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারত সরকারের কাছে আমরা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তারা অনুমোদন করেছে। এখন প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন করলে বাকি বিস্তারিত বলার পরিবেশ হবে। এখন এর বাইরে আর কিছু বলতে পারবো না।

গত ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে এ প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। একনেকে অনুমোদনের সময় প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ২ হাজার ৫৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারত সরকার ২ হাজার ১৮৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দিতে সম্মত হয়েছিল।

কারিগরি প্রশিক্ষণে ব্যস্ত পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

কিন্তু বাস্তব অগ্রগতিতে প্রকল্পটিতে ভারত সরকার আর অর্থায়ন করতে চায় না বলে মনে করেন ইআরডির এক কর্মকর্তা।পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ সৃষ্টিতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটির বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের জুনে। মহামারির কারণে প্রকল্পটির মেয়াদ এ বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটি প্রথম সংশোধনীর জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রথম সংশোধন করে ০.০৮২ শতাংশের প্রকল্পটির মেয়াদ জুন ২০২৬ সালের পাশাপাশি ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

চীন আর ভারতের ক্ষেত্রেই শুধু এরকম শর্ত দেখা যায়। ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির এতো শর্ত থাকে না। যার ফলে এই দুই সংস্থার কাছ থেকে ঋণের প্রকল্প যতটা দ্রুত শেষ হয়, ভারত বা চীনের প্রকল্পগুলো সেটা হয় না। 

বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ

পিইসি সভার শুরুতে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের যুগ্মপ্রধান জানান, আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে শ্রমবাজার পরিবর্তিত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এই প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে অংশ নেওয়ার জন্য প্রযুক্তিভিত্তিক তথা কারিগরি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের কোনো বিকল্প নেই। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) এবং এসডিজির (২০১৬-২০৩০) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ২০ শতাংশের কার্যক্রম নিয়েছিল। 

বর্তমানে বাংলাদেশে ৪১টি জেলায় ৪টি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ মোট ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু আছে। এছাড়া, ‘২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ২৩ জেলায় একটি করে নতুন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজও চলমান আছে।

পিইসি সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের মোট ১১২টি ভবনের অবকাঠামো নির্মাণ/উন্নয়ন করা হবে। এছাড়া ল্যাব ইকুইপমেন্ট ও মেশিনারি ক্রয়, কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন ও উন্নয়নসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা হবে। এ পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগীর সুপারিশ অনুযায়ী প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্টের (পিএমসি) মাধ্যমে সকল পূর্ত কাজ, যন্ত্রপাতি/সরঞ্জামাদি ক্রয় ও প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে সংশোধিত ডিপিপিতে অর্থবরাদ্দ ও পিএমসি নিয়োগের সংস্থান রাখা হয়েছে। এছাড়া পিডব্লিউডির ২০১৮ সালের রেট সিডিউল অনুসারে পূর্ত কাজের ব্যয় প্রাক্কলন, প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান এবং সিডি ভ্যাটসহ অন্যান্য অসামঞ্জস্য খাতগুলো সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন প্রয়োজন।

বর্তমানে প্রয়োজন প্রযুক্তিভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা, ক্লাসরুমে মনোযোগী শিক্ষার্থীরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. শামসুর বলেন, প্রকল্প শুরুর দুই বছর পর ভারত জানায় এটি পিএমসির মাধ্যমে করতে হবে। কিন্তু অনুমোদিত ডিপিপিতে পিএমসির কোনো সংস্থান এবং বাধ্যবাধকতা না থাকায় প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে পিএমসির মাধ্যমে কাজ শুরু করতে অনেক সময় প্রয়োজন হবে। এজন্যই সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে আমি আর কিছু বলতে পারবো না, কারণ আমি ঢাকার বাইরে আছি।

কমিশনের সূত্র জানায়, প্রকল্প শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সাত বার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা হয়েছে। যা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ধীরগতির অন্যতম প্রধান কারণ। প্রকল্পটির সংশোধন প্রস্তাব করার আগে এর দুর্বলতাগুলো অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। ব্যর্থতা ও ত্রুটিগুলো অনুসন্ধান না করে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাস্তবায়ন মেয়াদ শেষে অগ্রগতির হার যদি এমন হয়, তাহলে তো বাস্তবায়নকারী সংস্থার দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। মূলত ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা থাকে। যেমন, ভারতের সাথে আমাদের প্রকিউরমেন্ট মিল না থাকা, তাদের ওখান থেকে অনেক মালামাল ক্রয় করাসহ নানা জটিলতা থাকে। এগুলো পার করে একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সময়সাপেক্ষ।

তিনি বলেন, চীন আর ভারতের ক্ষেত্রেই শুধু এরকম শর্ত দেখা যায়। ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির এতো শর্ত থাকে না। যার ফলে এই দুই সংস্থার কাছ থেকে ঋণের প্রকল্প যতটা দ্রুত শেষ হয়, ভারত বা চীনের প্রকল্পগুলো সেটা হয় না। এজন্য বলবো, প্রয়োজনে আরও আলোচনার মাধ্যমে এই শর্তগুলো সহজ করা উচিত। কারণ একটা প্রকল্পের সাথে বিশাল জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা জড়িত থাকে।

এসআর/এনএফ