দেশে ষাটোর্ধ্ব প্রতি ১২ জনে একজন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত
বাংলাদেশে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়ায় (স্মৃতিভ্রংশ) আক্রান্ত বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।
বুধবার (৩০ জুন) রাতে আইসিডিডিআর,বি আয়োজিত 'বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার ব্যাপকতা: জাতীয় সমীক্ষার ফলাফল' শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনায় এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞাপন
আইসিডিডিআর,বি ছাড়াও গবেষণায় অংশ নেয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল।
ওয়েবিনারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর প্রফেসর ডা. রোবেদ আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইসিডিডিআর,বির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ড. তাহমিদ আহমেদ, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ।
বিজ্ঞাপন
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ডিমেনশিয়া এমন একটি সিনড্রোম যেক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং প্রতিদিনের ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের ডিমেনশিয়া রয়েছে এবং এর ৬০ শতাংশ নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশে বসবাস করেন।
তারা বলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে খুব কম তথ্য রয়েছে যা প্রবীণ নাগরিকদের সেবা দিতে নীতি নির্ধারকদের একটি বাস্তবমুখী কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। অন্যদিকে, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশিরভাগ প্রোগ্রাম প্রজননক্ষম বয়সের মানুষকে কেন্দ্র করে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সাতটি বিভাগে ২০১৯ সালে আইসিডিডিআর,বি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, শহুরে এবং গ্রামীণ অঞ্চলের ২ হাজার ৭৯৬ জন ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে এই জরিপ চালিয়েছে। জরিপের মাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়া এবং প্রধান অসংক্রামক রোগ বিস্তারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গবেষণায় বয়স্ক ব্যক্তিদের ডিমেনশিয়ার প্রকোপ, অঞ্চলভিত্তিক এর ভিন্নতা এবং স্বাস্থ্য সেবার ধরন পর্যালোচনা করা হয়েছে।
গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কিছু ফলাফল পাওয়া গেছে
১. প্রতি ১২ জন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির মধ্যে একজনের ডিমেনশিয়া দেখা গেছে (প্রকোপ ৮ শতাংশ) এবং নারীদের মধ্যে সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ডিমেনশিয়ার প্রকোপ ২.৫ গুণ বেশি।
অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রাজশাহী এবং রংপুরে (১৫ শতাংশ এবং ১২ শতাংশ) ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বেশি এবং শহুরে ও গ্রামীণ অঞ্চলে (৮ শতাংশ)-এর মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়নি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কখনও স্কুলে যায়নি এবং যাদের স্ত্রী বা স্বামী নেই সামগ্রিকভাবে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ তাদের মধ্যে অন্যদের চেয়ে বেশি দেখা গেছে।
২. ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্ধেকেরও বেশি হাইপারটেনশন (৫২ শতাংশ), হতাশা (৫৪ শতাংশ) এবং ডায়াবেটিসসহ (৮ শতাংশ) এক বা একাধিক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা (মাল্টিমর্বিডিটি) ছিল।
৩. ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি পুষ্টির অভাব (৩৫ শতাংশ কম ওজন), স্বল্প শারীরিক ক্রিয়াকলাপ (৪৯ শতাংশ), উচ্চমাত্রায় লবণ গ্রহণ (৫৬ শতাংশ) এবং উচ্চমাত্রায় তামাক সেবন (৭৬.৬ শতাংশ) করতে দেখা গেছে যা সাধারণত নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (অসংক্রামক রোগ) ঝুঁকির কারণ।
৪. ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় সবারই (৯০ শতাংশ) গত ৬ মাসে স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন হয়েছে বলে জানা গেছে এবং তারা চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে (১২ শতাংশ) ও সরকারি হাসপাতালের (৫.৪ শতাংশ) যোগ্য ডাক্তারদের চেয়ে প্রায়ই কোনো ওষুধ বিক্রেতার কাছে (১৬.৬ শতাংশ) গিয়েছিলেন। এই স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ধরনটি রোগীদের লিঙ্গভিত্তিক, বসবাসের স্থান (নগর বা গ্রামীণ অঞ্চল) ভিত্তিক কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি।
গবেষণার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক এবং গবেষণার কো-পিআই অধ্যাপক ড. কাজী দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, ‘সমাজের মধ্যে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে, তাই খুব বিলম্বে রোগ নির্ণয় হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগী হয়ে আমাদের ডিমেনশিয়া নিয়ে আরও গবেষণা চালানো দরকার, যাতে আমরা ডিমেনশিয়া বৃদ্ধির কারণ শনাক্ত এবং এটির উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারি।’
করোনা নিয়ে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘বিশেষত বহু রোগে আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। তবুও আমাদের কাছে প্রবীণদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সামগ্রিক পরিষেবা মডেল নেই। তাই, সরকারি, বেসরকারি এবং গবেষণা সংস্থার প্রচেষ্টায় এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য একটি সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’
আইসিডিডিআর,বি-র ইনিশিয়েটিভ ফর নন-কমিউনিকাবল ডিজিজ ইউনিটের প্রধান এবং গবেষণার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. আলিয়া নাহিদ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরাই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ নাগরিকের কাছ থেকে তথ্য নিয়েছি এবং ডিমেনশিয়ার প্রকোপ অনুমান করেছি। বার্ধক্য অনস্বীকার্য, এজন্য বয়স্ক ব্যক্তির যত্নকে কেন্দ্র করে সহানুভূতিশীল সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণার তথ্য-উপাত্তগুলো প্রচলিত বায়োমেডিক্যাল পদ্ধতির বাইরে এক বিস্তৃত স্বাস্থ্যসেবা মডেল তৈরি করতে সহায়তা করবে।’
সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে যে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ডিমেনশিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৩ লাখে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হবে ২৪ লাখ।
গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ, বেসরকারি এবং সরকারি পর্যায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক। পাশাপাশি এদেশে একটি উদ্ভাবনী স্থানীয় প্রমাণভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার প্রকোপ কমানো যাবে।
টিআই/জেডএস